ময়মনসিংহে আমাদের বাসাটা ছিল পুরান একতলা একটা বাসা। কেনার পর আব্বা টুকটাক কাজ করিয়েছিল। প্রতিটি বেডরুমের সাথে এটাচড বাথ, ভেতর বারান্দা বড় করে অর্ধেক দেয়াল আর অর্ধেক গ্রিল দিয়ে ঘিরে খোলামেলা ডাইনিং, বড়সড় একটা আধুনিক সুবিধা সম্পন্ন কিচেন। আমার বিয়ে হয়ে গেছে ততদিনে। আমি তখন মেহমানের মত যাই, কদিন থাকি চলে আসি।যে কদিন থাকি, রাত হলেই আমার ভয় লাগে। আমাদের রুমের কোনায় একটা অতি প্রাচীন কাঁঠালগাছ। জানলা খুললে দিনের বেলাতেও কাঁঠালতলার অন্ধকার দেখা যায়। আব্বার বাগানের শখ থাকায় ছোট্ট উঠোন ঘিরে একটা ছোট খাট বাগান করে ফেলেছিল। আম থেকে শুরু করে কচুর ঝোপ পর্যন্ত ছিল। ছিল দোলনচাঁপা গোলাপ রঙ্গন সহ নানান দেশি-বিদেশি ফুলের গাছ। বাগানের কোনায় কোনায় তাই আবছা অন্ধকার ঘাপটি মেরে থাকত ।যাহোক আমি রাতে ভয় পেতাম বলে আমার সাথে কাউকে শুতে হতো। তবু মাঝরাতে আমার গাঢ় ঘুম ভেঙে যেত। আর আমার শুধু মনে হতো ঘরে ঘুমন্ত মানুষজন ছাড়াও আরও কেউ আছে, যে আমাকে দেখছে।
তেমনি এক রাতে ঘুমিয়ে আছি। হাতদুটো মাথার দুপাশ দিয়ে খাটের বাইরে ঝুলে ছিল, ওটাই আমার শোয়ার অভ্যেস ছিল তখন। ঘুম অত গাঢ় ছিল না নিশ্চয়ই। কেননা, মাঝরাতে হঠাৎই মনে হলো আমার ঝুলে থাকা হাতে কেউ জোরেশোরে একটা বাড়ি দিয়ে গেল। এত চমকে গেলাম, আর ভয় পেলাম যে সড়াৎ করা হাত টেনে নিলাম, বুকের ভেতর হাতুড়ি পেটার শব্দ। এত টাটকা ছিল যে মনে হলো তখনো হাতে স্পর্শ লেগে আছে। কোনমতে এরপর বাকি রাত পার করলাম। কিন্তু দিনের বেলাতেই আমার জন্য অপেক্ষা করছিল আরো ভয়ঙ্কর কিছু অভিজ্ঞতা ।পরের দিন এই গল্প সবাইকে বললাম। বাসায় আব্বা আম্মা দুই বোন ছাড়াও থাকত আমার এক মামা। এক ফুপুও থাকত। আর সেদিন ভাগ্যক্রমে উপস্থিত ছিল আমার নানিও। মামা সব শুনে বলল, এ আর এমন কী! সে নাকি প্রায় প্রতিদিন দেখতে পায় একটা প্রাণীর অবয়ব ৷ উঁচু মোটা বাউন্ডারি ওয়ালের উপর দিয়ে হেঁটে যায় সেই অবয়ব।বাসা লাগোয়া একটা ওয়ার্কশপ বা গ্যারাজ ছিলো। দিনরাত সেখানে ঘটাং ঘটাং শব্দে কাজ হতো। মামার বাইক, বড়খালার গাড়ির কাজও ওখানে করা হতো। ফলে সব কর্মিরাই চিনত আমাদের। ওরাও নাকি মামাকে বলেছিল, ভাই আপনাদের বাড়িতে কিছু একটা আছে। রাইতে বাইর হইয়েন না। এ পর্যন্ত শুনে আম্মা হাসলো। বললো, হ্যা পুরান বাড়ি তো! এসবে কিছু কিছু জিনিস থাকে। তবে এখানে যারা আছে তারা খারাপ না। ভালো।
আমাদের ডাইনিং টা খোলা বারান্দায় হাফ ওয়ালের উপর গ্রিল লাগানো হলেও একতলা বাসা বলে রাতে গ্রিলের দরজায় তালা লাগানো থাকত। বাইরে টিউবওয়েল আর কাজের লোকদের টয়লেট ইত্যাদি ছিল। কিন্তু ওরা রাতে কেউ বাইরে যেত না। মামা আরও জানাল, ডাইনিং এ পানি-টানি নিতে আসলেও উঠানে চোখের সামনে পড়েছে কেউ কেউ কয়েকবার। দেখে আস্তে করে সরে গেছে।এবার ফুপু হাসতে হাসতে বলল, তুমি ভয় পাবা দেখে বলিনাই। প্রতিদিন ফজরের নামাজের সময় টুকটুক করে দরজায় তিনবার টোকা পড়ে। আমরা প্রথমে ভাবতাম ভাবি নামাজের জন্য ডাকে। পরে জিজ্ঞেস করে জানলাম ভাবি কোনদিনই ডাকে নাই আমাদের। আম্মা আর দুই বোনও সমর্থন করলো ফুপুকে। আম্মার রুমে মাথার কাছে জানালায়ও নাকি তিন টোকা পড়তো ফজরের সময় উঠতে দেরি করলে। আমি ততক্ষণে হতবাক হওয়ার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছি। অবাক হয়ে একেকজনের দিকে তাকাচ্ছি।কিন্তু আমার জন্য আতঙ্কের আরো কিছু খবর বাকিই ছিল তখনো। তাই বুঝি মুখ খুললেন আমার নানি। নানি সিরিয়াস, ‘যারা আছে তারা ভালোই। আমি একদিন খালি ঘরে এশার নামাজ পড়তেছি। বসে আত্তাহিয়াতু পড়তেছি, একটু ঝিমুনি চলে আসছে হঠাৎই মনে হইলো কে জানি একটা ধাক্কা দিল! ঘুম সাথেসাথেই চলে গেল।’আমার মাথায় হাত।রাত আসার আগেই এই বাসা থেকে পালায়ে ঢাকায় আসব কীভাবে, এই চিন্তায় আছি। এমন সময় দেখি সবাই মুখ টিপে হাসে।আম্মা মাথা নেড়ে না সূচক ইশারা দিচ্ছে।বোনেরা এবার হাসিমুখে ছোটখাটো একটা ককটেল ফাটালো, আপামনি তো তোমার সাথেও কী জানি দেখছিল!আমার আত্মা খাঁচাছাড়া হয়ে উড়ে যাওয়ার মত অবস্থা তখন।কোনমতে চিঁচিঁ করে জিজ্ঞেস করি, আমার সাথে?! কী দেখছো আপামনি? বল না! আপামনি দেখি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। আম্মাও তার মাকে মাথা নেড়ে বলতে না করছে।আমার তখন মাথা ঠিক নাই। চেপে ধরলাম নানিকে।যা শুনলাম তা মনে হয়ে এখনো গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।এক রাতে আপামনি তাহাজ্জুদের জন্য উঠেছে। পাশের খাটে আমি ঘুমাচ্ছি। উনি দেখলেন সাদা শাড়ি পরা ঘোমটা দেয়া খাটো মত এক মহিলা আমার পায়ের কাছে বসে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।আপামনি হতভম্ব হয়ে একটু জোরেই চেঁচিয়ে উঠলেন, এই! কে কে?! সেই শাড়িপরা খাটো নারীটি তৎক্ষনাৎ উঠে গুটগুট করে দৌড়ে কোন দিকে জানি চলে গেল, আপামনি খেয়াল করতেই পারেনি আর।এ আমি কী শুনলাম!আমার অগোচরে আমার মত ভীতু মানুষের সাথে এ কী লীলাখেলা!যাইহোক এরপর থেকে আমি আর রিস্ক নেই না। পায়ের উপর সারাবছর একটা পাতলা কাঁথা দিয়ে ঘুমাই। আর হাতদুটো ঢুকিয়ে রাখি বালিশের নিচে।অভ্যাস হয়ে গেছে।কে জানে তেনারা যদি সত্যিই হাত পা ধরে টানাটানি করেন, ভয়ের চোটে আমি কি আর বাঁচবো?! আর জিল্লুর এই ঘটনা জানার পর অনেকদিন পর্যন্ত রাতে উঠে বসে আমার পায়ের কাছে চেক করত, সাদা শাড়ি পরা কেউ বসে আছে কীনা। তার দেখা পেলে কী কী করবে সেই প্ল্যানও ঠিক করে রেখেছিল। যদিও তিনি তাকে কখনোই দেখা দেননি।

Be the first to write a comment.