ছোট চাচীকে আমি ফেইস বুকে ঢুকিয়ে দিলাম। রীতিমত ঠেলে ঠুলে ঢুকিয়ে দিলাম। এর সাথে ‘গুছিয়ে’ শব্দটা দিতে পারলে ভাল হত। বাক্যে ‘গুছিয়ে’ শব্দটা দিতে গেলে যা কিছু শেখানো প্রয়োজন ছিল, সব কিছু তার থেকে আসলেই শেখানো হয়নি, আমি শিখিয়ে দিতে পারিনি। তবে একাউন্ট খুলে যোগ করে দিয়েছি সব স্বজনদের। উনি চোখে চশমা লাগিয়ে, কখনোবা চোখ বড় করে, কখনো কুঁচকে, আবার কখনো হাসি মুখে ওনার ফোনের দিকে চেয়ে থাকেন। আমার বর বললেন, তোমার চাচী তো ফোনের ভেতরই ঢুকে পড়েছেন। সবাই আজকাল সারক্ষণ থাকে চেয়ে ফোনের দিকে, চাচীর আর কি দোষ। ৬৬ বছরের কাছাকাছি একজন মানুষ এত আগ্রহ করে ফেইসবুকে কি করেন আমারই মাঝে মাঝে তা জানতে মন চায় । আমিই তাই প্রায়ই জানতে চাই, কি দেখছেন চাচী। উনি সাথে সাথে বলেন ঝগড়া দেখি। ঝগড়া উনি কিভাবে দেখেন আমি জানি না। দেখেন এবং বিরক্ত হন। নিজে নিজেই বক বকান। বকবকানি থেকে আমি বুঝে নিতে পারি ঘটনাটা কি। তখন হাসি। কেউ হয়তোবা বলেছে বেগুনি শাড়ী কিনবে তাই নিয়ে হয়তোবা আরেকজন কেউ বলছেন না হলুদ ভাল হবে, এবং কেন এবং ইত্যাদি। কখনো আবার যখন ওনার কথা থেকে বিষয়টা উদ্ধার করতে পারি না তখনও ওনাকে তা বুঝতে না দিয়ে হু হা করে মাথা দুলাই যেন সবই উনি ঠিক বলছেন। আমার যে আসলে ওনার জগতের সব কিছু বোঝার দরকার নেই সেটা ওনাকে বুঝতে দিতে চাই না।
উনি সেই পুরানো আমলের মোটামুটি শিক্ষিত একজন মানুষ, একটি গ্রামের স্কুলের শিক্ষিকা। কিন্তু টেকনোলজিতে একেবারেই দক্ষ নন। একটু দক্ষও নন। ক’দিন ওনাকে ফলো করার পর বুঝলাম ফেইসবুকে একে যে অপরের সাথে তর্ক বিতর্কে লেগে থাকেন তাই উনি খুব উপভোগ করেন, ওটাই ওনার কাছে ঝগড়াঝাটি। আমি চাই প্রবাসের এই ক’টা দিন উনি নিঃসঙ্গতা ভুলে থাকুক। ঐ ফেসবুককে বুকে আগলে, দেশ ও জাতির সাথে মিশে থাকুক। যদিও বুঝি দেশেও সম্ভবত উনি এতটা আগ্রহ আর উৎসাহ নিয়ে দেশ ও জাতির যাবতীয় তথ্যে মন দিয়ে বসে থাকতেন না। কিন্তু এখন আছেন। থাকছেন। প্রবাসী যে উনি তাই আছেন, নতুন দেশ ছেড়ে আসা একজন তাই আছেন। গ্রিনকার্ডের দায়ে বাধা একজন প্রবাসী উনি। সকালেই আমি অফিস চলে যাই। ফিরি সাজে। সারাদিন ওনার বন্ধু ফোন। কল করেন ভাইবারে দেশময় সবাইকে। আমার ধারণা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নম্বরটা পেলে ওনাকেও ফোন দেবেন। আর এখন অবশ্য ফেইসবুকে আড়ি পেতে বসে থাকেন। সবার ব্যাপারে খোজ রাখেন। মন্তব্য করাটা পেরে না উঠলেও লাইক দেন। আমি ‘মন্তব্য’ লেখাটা শিখাই না। তাহলে আমাকে আরো অনেক বেশী কিছু সামাল দিতে হবে।
ফেইসবুকে দেখে দেখে আমি বুঝে গেছি, আমাদের মনোজগতের দাড়ি কমা সেমিকলোনগুলো এমনভাবে সাজানো যে তাতে এতটুকু এদিক ওদিক হাওয়া লাগলেই যেন সাথে সাথেই আমরা অপমানিত হয়ে পড়ছি। ফেইসবুকের নাম মাইন্ড বুক বললেও চলতো। অভিমান বই। কথায় কথায় বলে মাইন্ড নিয়েন না, অথচ সাথে সাথেই মাইন্ড করে সবাই, অযথাই। মšতব্য না করলেও চাচী কিন্তু ঝগড়াতে পরেই যান । যেন পা ফসকে ধপাস করে পরে যান আর আমিও সম্পৃক্ত হয়ে যাই। যদিও খুবই উটকো ঝামেলা এগুলো, তারপরও ধেয়ে আসে। কাণ্ড দেখি। অপ্রয়োজনীয় মনে হয়। এই প্রবাসের ব্যস্ততায় এতে মন দিব না ভাবলেও জড়িয়ে পরতে হয়। যেমন প্রথম ক’দিনের পরই দেখা গেল ওনাকে অনেকেই আনফ্রেন্ড করে দিয়েছিলেন। এতে খুবই মনোকষ্ট নিয়ে আমার দিকে তাকালেন। আমার আরেক চাচীও ওনাকে আনফ্রেন্ড করে দিয়েছিলেন। আর এক ফুপু তো ব্লকই মেরে দিয়েছেন। ফোন করলাম ঐ ফুপুকে। কি ব্যাপার, ছোট চাচীকে ব্লক করেছেন কেন? ঝনঝনিয়ে ফুপু বললেন, তোমার চাচী কি আমেরিকা গিয়ে মাছির ৫০০ পা দেখেছে! আমাকে সারাদিনে দুটো লাইক দেয় না, আর তোমার রত্না খালাকে লাইকের পর লাইক। আমি অবাক হয়ে ভাবলাম , ও আল্লাহ,এ কি সমস্যা।
বললাম, আনব্লক করে দিন। উনি চোখে সব সময় ঠিক মতন ফোনের ভেতর ফেইসবুক দেখতে আর বুঝতে পারেন না। আর এই ভুল হবে না। আমি শিখিয়ে দেব। বুঝলাম বড় চাচীর সাথেও সে রকম কিছু হয়েছে। মিটমাটের জন্য বড় চাচীকেও ফোন করলাম। উনি শুনেই বললেন, আরে আমার তো ফেইস বুকই বন্ধ, ডিএকটিভেটও করে দিয়েছে তোমার চাচা। তোমার ছোটো চাচীকে আনফ্রেন্ড করিনি। আমি তো মহা অবাক। ডিএকটিভেট ! কেন? কি হয়েছে? ফুপী বললেন, তোমার চাচা বললেন ওটা হচ্ছে দিল-কা-কিতাব। মন খুলে সবাই গোপন কথা শিখছে লিখছে নামে বেনামে। আমার যে সব প্রেমিক ছিল ৫০ বছর আগে, যারা মরে কবরে চলে গেছে সেই সব ভ’তগুলোও নাকি আমাকে দেখার সুযোগ পেয়েছে। এ কথার পর আমিই তোমার চাচাকে বলেছি, আজই এখনই বন্ধ কর ফেইসবুক। আমি শুনে হাসতে হাসতেই বললাম, ভাল করেছেন চাচী। চাচারটাও বন্ধ করে দিয়েন। না হলে উনিও ৬০/৭০ বছরের পুরাতন অনেকের সাথে এক সাথেই টাংকী মারতে পারেন।
দূর, কি যে বল না তুমি, বলে চাচী অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলেন।
তাঁর দেবতা তুল্য স্বামীর চরিত্র হনন উনি অপছন্দ করলেন। আমি মুখ টিপে হেসে বলে দিলাম, বড় চাচাকে বলবেন ছোট চাচীকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাতে। শুনেই ছোট চাচী এদিকে আমার বাসায় চিল্লাতে লাগলেন, ‘হিতিরে হাগলা কুত্তায় কামড়াইছেনি’ ? হিতি মানে আমি, ভাসুরকে উনি বন্ধু বানাবেন কিভাবে! অতএব আমিই আসামী। আমাকে নাকি পাগল হয়ে যাওয়া কোন এক কুকুরে কামর দিয়েছে, না হলে এমন কথা বলছি কিভাবে আমি। যাই হোক দুই জা’কে ফোনে কথা বলার আর ভুল বুঝাবুঝির নিরসনের সুযোগ দিয়ে আমি আইক্রিম এক বাটি নিয়ে উপরের তলায় উঠে যেতে যেতে শুনলাম চাচী বলছেন, “হেতির ডক আঁরে বেয়ুশ করি আলাইছে।’ আমাকে বলছে! আমি এত সুন্দর হলাম কবে থেকে। আমি খুশি হয়ে তাকালাম। পরক্ষণেই বুঝলাম উনি আমেরিকাকে সুন্দরী বলছেন। আমাকে না। এতেও আমি আনমনে হাসলাম।
আমার বর আমাকে ডেকে বললো, ছোট চাচীকে একটুও ট্রেনিং না দিয়ে সোসাল মিডিয়াতে এভাবে ছেড়ে দেওয়া তোমার ঠিক হয়নি।
যদিও আমার ধারনা ট্রেনিং আর লাগবে না তারপরও একটু পরে চাচীর কাছে গেলাম, বলেও দিলাম, সবাইকে সমান ভাগে লাইক দিতে, কে কোন দলের সেটাও খেয়াল করতে। বাপের বাড়ীর দলটাকে সারাক্ষণ লাইক না দিতে। দলাদলির বিষয়টা খেয়াল না করলে এক ঘরে হতে হবে। যে একটা লাইক দেবে সাথে সাথে তাকে আরেকটা লাইকও দিতে বললাম, ভুল যেনো না করে। ছোট চাচী ভাবটা করলেন, যেন কোন এক কুরুক্ষেত্রের জন্য তাঁকে প্রস্তুত করছি। ৬৬ বছরের এই জীবনে আর কখনোই এমন গনাগনির, ভেবে চলার সমস্যায় তিনি পরেননি। বললেন ,নতুন ছবিতে লাইক দেওয়া শেষ হয়ে গেলে তখন কি করা যাবে। বললাম, পুরাতন ছবিতে লাইক দেবেন।
এত কুট চাল শেখানোর পরও অবশ্য চাচীকে রক্ষা করা গেল না। দুদিন পরেই আবার অভিযোগ এলো ‘লাইক’ দিয়েই আবার তুলে ফেলেন তিনি। এটা আবিষ্কার করেছেন বড় চাচী। একাউন্ট উনি চালু করেছেন আবার। বলেছেনও এটা নেশার মতন। এখানে এসে সবাইকে একবার না দেখলে এবং দেখালে ,ওনার মন ভরে না। যদিও ওনার বন্ধু সংখ্যা মাত্র ছয় জন। তিন চাচী আর এক ফুপু এবং ওনার দুই ছেলে মেয়ে। লিস্ট ছোট বলে সবার সব কিছুই ওনার চোখে পড়ে। আমাকে ওনাদের দুই জা-য়ের সেই সুন্দর আমেরিকায় ফোন করে বললেন, তোর চাচীর বিষয়টা কি? আজ লাইক দিচ্ছে তো কাল তুলে নিচ্ছে। আবার কি ভেবে পরশু সেটা ফিরিয়ে দিচ্ছে। রহস্যটা কি? আমি নিজেই প্রথমে বুঝলাম না। ওনার রুমে যেতেই উনি বললেন, “আই আবার কি কইচ্ছি।” বুঝলাম আমার মুখভঙ্গীতে কোন একটা নির্দেশনা থাকে যাতে উনি বুঝে যান ওনাকে এবার জবাবদিহি করতে হবে। আমি আপন মনে ভেবে দেখলাম চাচীর ভুলগুলো ফুল বানাতে আমি একই ধরনের মুখভঙ্গী নিয়ে হাজির হচ্ছি যা উনি দেখা মতই বুঝে যাচ্ছেন। ভাল কথা। জানতে চাইলাম, লাইক দিয়ে আবার তুলে ফেলছেন কেন? বেশ অবাক হয়ে বললেন, কই, না তো। সেটা কেন হবে।
বড় চাচীকে আজকে লাইক দিয়েছেন?
হ্যাঁ।
কয়টা?
চারটা। না না তিনটা।
তিনটা দিলে তো সমস্যা হবার কথা না। উবে যাবে না যদি তিনটা হয়। হঠাৎই আরেকটা সম্ভাবনার কথা মনে হওয়ায় বললাম, নতুন ছবিতে দিয়েছেন না পুরাতন। চাচী বললেন,উনি তো নতুন কোন ছবি দেননি। তাই আগের যে ছবিতে একটা লাইক দিয়েছিলাম সেটাতে আরেকটা দিলাম। তারপরে ভাবলাম আরো দুটো দিয়ে দেই। কি হবে আমারই তো জা, পাক বেশই লাইক পাক। আরো বললেন ওনার ফেয়ার পার্কের সব কয়টা ছবিতে উনার জা লাইক দিয়েছেন।
এবার আমি বুঝলাম যা ভেবেছিলাম তাই। চারবার লাইক করতে গিয়ে ‘লাইক’ ময়দান ছেড়ে ভেগেছে। বললাম নিজেরই একটা ছবিতে চারবার লাইক টিপুন, তারপরে দেখুন কি হয়। বললামও বুঝিয়ে কোন ছবিতে একটার বেশী দুটো লাইক দেবেন না। দ্বিতীয় বার লাইক দিলে লাইকই মুছে যায়, প্রথম লাইকটা চলে যায়। চাচী অসহায়ের মতন আমার দিকে চেয়ে থাকলেন। কিন্তু উনিও জানেন এসব নিয়ে যখন ঝামেলা হয় তখন তা তুমুল বেগেই হয়। ঝড়ের গতিবেগ ঘণ্টায় সর্বোচ্চরও বেশী কিছু থাকে। শেষ হয় আনফ্রেন্ড বা ব্লক দিয়ে। অতএব সাধু সাবধান।
এর দুদিন পরেই এসে দাড়ালেন খুব হতভম্ব মুখে। বললেন, দেখেছো সোহাগী কি লিখেছে ওর ফেইসবুকে?
জানতে চাইলাম কি লিখেছে। উনি ফোনটা এগিয়ে দিলেন। চেয়ে দেখলাম। সে নিজের সম্পর্কে ‘এবাউট ইউ’তে লিখে রেখেছে,
“লাইক না পাওয়াটা অপছন্দের। ট্যাগ করলেই ত্যাগ। শেয়ার করা কেয়ার করি না। ‘মন্তব্য’ না দিলে গন্তব্য বোঝা যাবে না, তাই কমেন্ট করেন আমার দেয়ালে। যারা এই নিয়মগুলো ফলো করতে পারবেন তারাই বন্ধুত্বের আবেদন পাঠাবেন, নিমন্ত্রণ নয় আবেদন। পছন্দ হলে ঢুকতে দেওয়া হবে আমার সিন্ড্রেলা ল্যান্ডে।’’
চাচী বললেন, পড়ে তো আমার মাথা ঘুরে গেল দুই চক্কর। এক্কেবারে ভৌ ভৌ করে ঘুরছে। ভীমরতি ধরেছে ঐ মেয়ের। আরো বকে চললেন।
নিজের ছেলের বৌয়ের ফেইসবুকে ঢুকার জন্য এত আবেদন নিবেদন চাচীর পছন্দ হবে না। শ্বাশুড়ী মাকে ঐ পুত্রবধু ঢুকাবেও না। বাসাতেই তো ঢুকতে দেয় না। ঢুকতে দেয় না মানে কম যাতায়াত। আমার বাসা থেকে কেরোলটন কাছেই। ধানমন্ডী থেকে আজিমপুর যতটুকু দূরত্ব ততটুকুই, শুধু ট্রাফিক জ্যামটা নেই এখানে। এত কাছে অথচ আসে কম। চাচী সম্ভবত ভাবীর সাথে ঝগড়া করেই আমার কাছে এসেছেন। আমি জানতে যাইনি কি হয়েছে। সময় আছে আমার এত ঝুট ঝামেলার! চারদিকে এত দৌড়াদৌড়ি। তারপরেও চাচীকে প্রচুর সময় দিচ্ছি। মায়া লাগে। নিজের ছেলেই যেন পর হয়ে গেছে ঐ বৌয়ের কারণে। বললাম, যা খুশী লিখুক, ফ্রেন্ড রিকোরেস্ট পাঠান, বন্ধু হলে প্রতিদিনের খবর ছবি এই সব পাবেন। নাতনীটাকেও দেখবেন। আমার এ কথাটা ওনার খুবই মনে ধরেছে। এবার বললেন ভুলে গেছেন কিভাবে পাঠাবেন ফ্রেন্ড রিকোরেস্ট। ওনার হাত থেকে ফোনটা নিলাম। চেয়ে দেখি চাচীর বহু ফ্রেন্ড হয়েছ। এরা কারা! চাচী বললেন, জানেননা। প্রশ্ন করলাম, তাহলে আপনার একাউন্টে এলো কিভাবে? কে এ্যাড করেছে এদের।
উনি তাও জানেন না।
জিজ্ঞেস করলাম কাওকে আইডি পাসওয়াড দিয়েছেন? বলেই বুঝলাম, আরে আমিই তো ওনাকে সেটা দেইনি। এইসব উল্টাপাল্টার ভয়েই দেইনি। বুঝলাম সারাক্ষণ যে টিপাটিপি করেন তখনই কোন এক ফাঁকে সবাইকে যোগ করেছেন। নিজেও জানেন না কি করেছেন। এ কি এক বিপদ! দেখে বুঝলাম বেনামী ভুয়া কিছু একাউন্টও আছে, নাম যেমন, ‘তিব্বত থেকে আসা’, ‘নদীর নাম হায়না’। নদীর নাম নাকি হায়না ! হয় কখনো এরকম। বললামও ওনাকে, উনি চোখ আরো বড় করে বললেন, আই কিচ্চি? ওনার সাথে এরপর কিচির মিচির না করে ডিলিট করলাম আইডিগুলোকে। তার আগে ঢুকে দেখলাম উদ্দেশ্য কি এদের। কেন চাচীর সাথে সখ্যতায় আগ্রহী। ওনারা দুজনই ইনবক্সে হাত ওয়েভ করেছেন। কেমন আছেন জানতে চেয়েছেন। চাচীর দিক থেকে কোন সাড়া নেই। উনি ঢুকেও দেখেননি। সম্ভবত জানেনও না কিভাবে ইনবক্সে যায়। আরেক অচেনা হিরো মার্কা ছেলে, সেও দেখা যাচ্ছে চাচীর বন্ধু হয়েছে। তার ওয়ালে লেখা, ‘‘আজ ‘মেহনতি মানুষ’ নামের একটা ফেইক আই ডি থেকে আমার নাম ব্যবহার করে বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার গ্রুপের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে একটা পোস্ট দেওয়া হয়। সেইটি আমার করা নয়। পড়লেই সুশীল সমাজের মানুষ অনুধাবন করতে পারবেন কোথায় গলদ। যে এই কাজটা করেছে সে মানুষের চেহারায় অমানুষ।’’ পড়ে শোনালাম চাচীকে। চাচী হাসলেন,বললেন, কিছুই তো বুঝলাম না। আমি আর জানালাম না যে ফেইস বুক পলিটিক্স না বুঝলেও চলবে। আর ওটা বুঝাও অত সহজ না। উনি বললেন ‘মেহনতি মানুষ’ নামের ফেইক আই ডি -কে লাইক দিতে। উনি ওটা-ই পারেন, লাইক দিতে কারনে বা অকারনে। জানি আমি না দিলেও উনি দেবেন। বললাম ,অচেনা জায়গায় লাইক খরচ না করতে। উনি সাথে সাথে বললেন উনি নাকি শুনেছেন বা ফেইসবুকে পড়েছেন যে অঢেল লাইক দিতে থাকলে জুখার বার্গ নাকি পার লাইক একটা করে বর্গারের পয়সা নেবে। বললাম, আমি কিছুই জানি না। তবে ফেইসবুকে যা দেখেন তার সব কিছু বিশ্বাস করবেন না। বুঝে শুনে ইমো দেবেন। বলে ওনাকে হা হা, লাভ, ইমোজীগুলো দেখালাম। চাচীতো মহা খুশী। ওনার জ্ঞানের পরিধি বাড়লো বলে। তবে ওনাকে সাবধান করতে বললামও, ওনার ছেলের বৌয়ের একটি ঘটনার কথা, বললাম ভাবী একবার হাতের ব্যালেন্সের ভুলে লাইকের বদলে হা হা হাসির একটা ইমো দিয়ে দিয়েছিলেন ওনার কোন এক বান্ধবীর বাবার কফিনের ছবিতে। তারপর থেকে বহুদিন পর্যন্ত ঐ বান্ধবী কথা বলেনি ভাবীর সাথে। পরে এক সময় কারনটা ভুলটা জানা গেলে তারপরে মিটমাট। অতএব চাচী, ফেইসবুকের কোন কথায় কোথায় কার উপর কে ক্ষেপে ব্যোম হয়ে বসে থাকবে বুঝতেও পারবেন না কেও। তাই খুব সাবধান চাচী।
চাচী সাথে সাথে বললেন, ঐ মেয়ে ঐটা করতেও পার। দেখ না ,আমি মরলে ঐ মেয়ে হাহা হিহির সব ইমো মারবে আমার কবরে। আমি চুপ করে গেলাম। এদের পারিবারিক কলহে আমি নেই। চাচী থেমে নেই। পুত্রবধুর মুণ্ডু চটকানোর সুযোগ হাত ছাড়া করেন কি করে। বললেন কফিনে লাইক দেওয়া কি ভাল কথা। মানে কি তোমার বাপের লাশ দেখে আমি তা পছন্দ করছি। আমার আর চাচীকে বলতে ইচ্ছে হলো না এই লাইক মানে একোনলেজমেন্ট। ধুর, কে এতো জ্ঞান দেয় চাচীকে।
আমি হিরোকে আনফ্রেন্ড করলাম। আরো কয়েকজনকে বাদ দিলাম। ছেলের বৌকে বন্ধু বানানোর রিকোয়েস্ট পাঠালাম। শ্বাশুড়ীকে দেখলাম বউ সাথে সাথেই বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করলো। বাস্তবে যে সম্পর্কই থাকুক না কেন ভারচুয়াল ওয়াল্ডে সবাই বন্ধু। ভালই। বললাম চাচীকে, ছেলের বৌ তো বন্ধু হয়ে গেল। তবে অনেক ছাত্র নেতা নেত্রী আছেন ভাবীর একাউন্টে, তাই ভুল করেও কোন মন্তব্যে লাইক দেবেন না। শেষে ভাবী বিপদে পড়বে। গণধোলাই খেতে হবে। চাচী ভয় পেয়ে বললেন, বাসায় চলে আসবে নাকি আবার সবাই। আমি স্বান্ত¦না দিয়ে বললাম আরে না না, সব ওই ঘরে বসেই। আজকাল বাঘ ভাল্লুক সবই মারে ঐ ঘরে বসে ফেইসবুকে।
কয়েক দিন পর দেখলাম চাচীকে হঠাৎ অনেক সুন্দর ও ইয়াং দেখাচ্ছে। বুঝলাম চুলে কালার দিয়েছেন। বেশ সেজেছেন। বললেন, একটা ছবি তুলে দিতে, ফেইসবুকে দেবেন , বুঝলাম ফেইসবুক ওনাকেও রুপসী হতে উৎসাহ যোগান দিচ্ছে। চাচী গেলেন কাগজ কলম আনতে, আরো নাকি কি কে লিখে নিতে হবে ওনাকে। আমি চাচীর ফেইসবুকে আর কি খেয়ালে রাখতে হবে তা ঘেটে দেখছি।
ওরে আল্লাহ,এদিকে দেখছি ভাবীর একাউন্টে তো রীতিমত যুদ্ধ চলছে। কেও একজন কবিতা ট্যাগ করেছে ভাবীকে। তাই নিয়ে ভাবী যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। লিখেছেন, কোন ট্যাগ করবেন না আমাকে। কবিতা তো নয়ই। প্রেমের কবিতা সারাক্ষণ সবাইকে পাঠানো নিচু মানষিকতা। সময় পেলেই সবাই আজকাল কবি হয়ে উঠতে চায়। পেয়েছে এক ফেইসবুক। পারুক না পারুক লিখে ফেলে পাঁচ লাইন। তার পরে ছড়িয়ে দেয় ফেইসবুকের আনাচে কানাচে। নিজের কাছে রাখুন এইসব ব্যক্তিগত কবিতা।
ঐ অচেনা ছেলেটি ট্যাগ করা কবিতাটির নিচে লিখেছে, কবিতা কি ভাবে ব্যক্তিগত হয় বুঝলাম না। এটা তো সার্বজনীন। ভাবী লিখছেন, এইসব সেক্সী কবিতা ব্যক্তিগতই হয়।
সারছে ভাবী আজকে মারই না খায়। ভাবীর সেদিকে খেয়াল নেই, বলে যাচ্ছেন,
ছোট ছোট পুটি মাছের মতন কবিরা জন্মেই লাফাতে থাকে আপনার মতন। ট্যাগ-ই হচ্ছে লাফানো।
ছেলেটি বলছে, নামটা কি এই ছেলের, মনযোগ দিয়ে দেখলাম, নাম মুরাদ, সে বলছে, আপনি কবি তাই আনফ্রেন্ড করতে খারাপ লাগছে। ভাবী কবি হলো কবে? আমি তো জানি না। ছুটে ভাবীর প্রফাইল এ ‘এবাট মি’ চেক করলাম। হুম ,লেখা তো আছে কবি। নিজে নিজে গোপনে লিখে মনে হয়। একা একা গভীর রাতে লেখে আর ভাইকে শোনায় হয়তোবা। আমি পিক করে হেসে দেই। আমরা জানিনা অথচ ফেইসবুকবাসী জানে। ভাবী জোরেসোরে চেঁচিয়েই যেন বলছেন, এক্ষুণি আনফ্রেন্ড করুন মুরাদ। ভাবী করে দিলেই তো পারেন,তা না করে ওনাকে বলছেন কেন তা বুঝিনি।
মুরাদ বলছেন, সরি আমার মনে হয় ‘কবি মুরাদ’ বলা উচিত, উনি বলছেন, করে দিচ্ছি, আমি ছোট কবিদের আমার সাথে রাখতেও চাই না।
আমার হা হা করে হাসতে মন চাইলো। চাচী দেখলে খুবই খুশী হতেন কিন্তু ঐ যে আমি এইসব ঝামেলা থেকে দূরে থাকবো বলে বদ্ধপরিকর তাই চাচীকে বললাম না। ভাবী অত্যন্ত রুক্ষভাবে বলছেন, আপনি তৃনসম। সেক্সী কবিতা লেখেন আবার কথা বলেন। বেশরম। শরম নাই।
কবি মুরাদ লিখেছেন, দিদি এক্ষুণী পালিয়ে যাচ্ছি ,এ জীবনে আর এমুখো হব না।
যান, চলে যান। চলে গেলে তো আর লেখা আমার ওয়ালে দিতে পারবেন না, মন্তব্য ও না। আমার একাউন্ট পাবলিক না, ফ্রেন্ডস অনলি।
ছেলেটার আর কোন জবাব নেই। ভাবলাম চলে গেছে। ভাবী এতো ক্ষেপেছেন কেন তা বুঝলাম না যদিও।
আমি কবিটার একাউন্টে গেলাম, এটা পাবলিক। সবই দেখা যাচ্ছে। খারাপই লাগলো এই পুচকা কবি-টার জন্য। কী তাড়াই না খেল।
দেখলাম ছেলেটা স্টেটাস দিয়েছে,
কেন যে ট্যাগ দিতে গেছিলাম, কবিতাটার নাম বদলে কুফা নাম দিলাম।
সাথে সাথে তার বন্ধুরা মন্তব্য করছে। কে যেন একজন লিখেছে, তোমার নিজের নামও কুফা দিয়ে দাও।
পরের ক্ষণেই দেখলাম , সে আরেকটা স্টেটাস দিয়েছে ‘আমি একজন ছাগল’।
আমার খুবই হাসি পেল। আমিও উড়ে গিয়ে এটাতে হা হা ইমো দিলাম।
মায়াই হচ্ছে ছেলেটার জন্য।ছবি দেখেই বুঝা যাচ্ছে অপরিনত ১৯/২০ বছরের বাচ্চা ছেলে একটি। যুবক যুবক ভাবটাও এখনও আসেনি পুরোপুরি।
ভাবীর স্টেটাসে লিখেই ফেললাম,
কবিতা সেক্সী হয় কি করে। কবিতার কি শরীর আছে। দুধ, বুক, পাছা আছে?
সাথে সাথে দেখলাম মুরাদই অবাক হবার একটা ইমু দিয়ে মন্তব্য করলো, আমার রক্ষা কর্তা হয়ে যে তুমি এলে সেই সত্যিকারের সিন্ড্রেলা, লক্ষ জনের মন হরণকারী। বুঝলাম সে ধমক খেয়ে সরে যায়নি। আর তখনই আমার মনে পড়লো চাচীর একাউন্টের প্রফাইলে একটা ফুলের ছবি দেয়া মাত্র। চাচীর ছবি নেই। ছেলেটির বোঝার কোন কারণই নেই যে ৬৬ বছরের একজনকে সে সিন্ড্রেলা বলছে। কিন্তু ভাবী তো জানে এটা তার শ্বাশুড়ীর একাউন্ট।
আমি তো মনের ভুলে ভাবীর সাথে দুষ্টামী করতে গিয়ে চাচীকে ফাসিয়ে দিলাম।
যে বাজে কমেন্ট করেছি এটা তো চাচীকেও বলা যাবে না। হঠাৎই দেখলাম ভাবীর একাউন্টটা আর দেখতে পাচ্ছি না। ব-ল-ক করে দিয়েছে। লেখাটা ডিলিট করার পথও গেল। কবি সাহেবেরটা পাচ্ছি। তার নতুন স্ট্যাটাস, রাজকন্যার দেখা পেয়েছি। ভাবীও নিশ্চয়ই দেখতে পাচ্ছে ঐটা। অহ্ মাই গস, শ্বাশুড়ি রাজকন্যা, সারছে। এবার খবর আছে। বুঝতে পারছি ভাবী আমাকে মানে তার শ্বাশুড়ীকে ব্লক করে দিবেন জীবন থেকেও,অজুহাত উনি পেয়ে গেছেন।
চাচীর ফোন হাতে নিয়ে বসে আছি। জানি না কী করবো। ভাবছি। কি এক উটকো ঝামেলা। অযথা এতক্ষণ সময় নষ্ট হলো। আরো অনেকটুকু সময় নষ্ট হবে এই জ্বালা ময় জাল থেকে বের হতে। ভাবীকে এখন ফোন করে বলতে হবে ঐটা আমি ছিলাম। বাদরামী করছিলাম ওনার সাথে। চাচী ইননোসেন্ট। কিন্তু রাতের ১০টা বেজে গেছে। এই প্রবাসে এত রাতে কেও কাউকে ফোন করে না। তারপরও আমার ফোনের সামনে দাড়িয়ে ভাবছি করেই ফেলি। নিচের তলা থেকে করলে চাচী শুনে যাবেন। উপরের তলাতেই চলে যাই ভাবছি। কিন্তু ওখানে আবার আমার বর আছেন। সে শুনলে আবার অনেক প্রশ্ন করবেন। কি করি, ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। ফোনে মেসেজ পাঠালাম ভাবী জেগে থাকলে আমাকে একটা কল দেওয়ার জন্য। অনেকক্ষন গেল,কোন খবর নেই।
রাতের খাবার গরম করতে করতে ভাবছি এবার কি করা উচিত। আর ঠিক তক্ষুণী কলিং বেল। এত রাতে কে! দরজায় গিয়ে তো আমার চক্ষু চড়াক গাছ। কিন্তু আমি কিছু বলার আগেই আমাকে সরিয়ে বেডরুমে গিয়ে ভাইয়া মানে চাচীর ছেলে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। ভাবী আসেন নি। ভাইয়াকে আমি কিভাবে কি বলবো ভাবছি!! সেক্স নিয়ে কথা বলেছে, ঐ বুড়ীকে আজ আর কে বাঁচাবে। দরজা তো বন্ধ যাতে আমি ওনার মায়ের কীর্তি না শুনতে পাই। দৌড়ে গিয়ে দরজার পাশে দাঁড়ালাম। চাচী সচরাচর শুদ্ধ ভাষায় কথা বললেও দেশী ফ্যামেলি ম্যাম্বারদের সাথে প্রায়ই একদম আদি ও অকৃতিম নিজ এলাকার ভাষা ব্যবহার করেন। আমি শুনতে পাচ্ছি, কিচ্ছি, কিচ্চিরে, এইচ্যা করর কিল্লাই এইসব বলছেন। ইসরে, কি যে করেছেন যদি বুঝতেন। নিজের মাথায় নিজে চাপড় মারতে লাগলাম। এক সময় চাপড়ালাম দরজা। দায়িত্ব নিতে হবে। দুধটুধ ঐসব ভাবী এলে ওনাকে বলা যেত। যাই হোক। দেখি কি হয়! হঠাৎ দরজা খুলে ভাইয়া বের হয়ে এলেন। মুখ রাগে ওনার একদম লাল। ভাবী নিশ্চয়ই আমার ঐ একটা লাইনকে দশগুণ বাড়িয়ে শ্বাশুড়ির বিরুদ্ধে লাগিয়েছে। ভাইয়া হুট হাট করে বের হয়ে চলে গেলেন। আমার একটা কথাও বলার সুযোগ হলো না।
চাচী এসে আমাকে বললেন, আই কিচ্চিরে মনা, হেতে এইচ্চা কইল্যো। আই তো বেকুব বনি গেলাম। এটুকু বলেই উনি হয়তো বুঝতে পারেন ওনার ঐ ভাষায় আমার দক্ষতা কম। বললেন, বউটা যে কি বুঝিয়েছে ছেলেটাকে কে জানে। তারপর আপন মনেই বললেন, হুদা হুদা, হুদা মিছা চিৎকুর দিল।
হুদা মিছা যে কিছু হয়না কে বলতে যাবে এখন ওনাকে! আমি? নেভার।
আমি খুব নিচু গলায় বললাম, কাল আমি ভাবীর বাসায় যাব। সকালেই, সব ঠিক হয়ে যাবে। ভাববেন না চাচী।
তারপর নিজের মাথায় নিজেই চাপর দিয়ে বললাম, কেও আমারে মারি ফেলা।
Be the first to write a comment.