পৃথিবীতে অরাজনৈতিক কবিতা বলে কিছু নেই। যাই লিখবেন, সেটা যতোই অখাদ্য হোক – তারও একটা রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থাকবে। পলিটিক্যালি ইনকারেক্ট হওয়া কিংবা সাইলেন্ট থাকাও কিন্তু একটা রাজনৈতিক অবস্হানই। প্রেম, যৌনতা, শরীরি আকর্ষণ, কিংবা স্রেফ প্লেটনিক ভালবাসা- যাই নিয়েই কবিতা লিখেন সেটাও রাজনৈতিক কবিতাই বটে। প্রেম, যৌনতা তো আসমান থেকে নাজেল হয় না। কার সাথে, কোথায়, কিভাবে, কোন ক্ষমতা বলয়ে দাঁড়িয়ে প্রেম-ভালবাসা করছেন বা করতে চাচ্ছেন তা পুরোটাই আপনার নিজস্ব রাজনৈতিক অবস্থান ও আপনার সাথে কামনার ব্যাক্তিটির ক্ষমতা সম্পর্কের বিষয়। প্রেমের কবিতাকে তাই এতোটা নাদানভাবে দেখার অবকাশ নাই।
সাদী শাশ্বত নামে এক লোক তার “পাহাড়ে চলে যাব” কবিতায় লিখেছেন-
“ কোনো এক দোল পূর্ণিমায় পূবের
পাহাড়ে চলে যাব। দুই সাঙ্কি মহুয়া আর
পাঁচটি শুকর দিয়ে লাল সোনা
চাকমা মেয়ে বিয়ে করব…
শহুরে শঠতা আমি তাদের
খোঁপার ভাঁজে রেখে দেবো…
সকাল দুপুর সাঁঝে, উন্মুক্ত উপত্যকায়
ঝোপে ঝাড়ে টিলায়, আমি তাদের সঙ্গে
উদাসীন সঙ্গমে মেতে রবো।”
এই কবিতাকে নিছক প্রেম, ফ্যান্টাসী হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। একাধিক নারীর সাথে প্রেম করতে চাইতেই পারেন কেও, যদি নারীরা সে বিষয়ে জেনেশুনে সম্মতি দেন। কিন্তু ইস্যু তো সেটা না। বরং ইস্যু হলো কিভাবে কিছু নির্দিষ্ট পরিচয়ের নারী খুব স্বস্তা হিসেবে আমাদের চিন্তা, চেতনা, গল্প-কবিতায় প্রতিষ্ঠিত হয়। লক্ষ্য করেন শ্বাশত কোন রেনডম নারীকে নিয়ে কবিতা লিখেননি। তিনি নির্দিষ্টভাবে আদিবাসী নারীকে স্বস্তা ‘বস্তু’ হিসেবে কামনা করেছেন। আপনার বাঙালী মুসলিম পুরুষালী চোখে এই কামনাকে নির্ভেজাল মনে হতে পারে। বোঝার সুবিধার্থে কল্পনা করেন যে কোন এক আদিবাসী মারমা কবি লিখছেন-
“৫ হাজার দেনমোহর দিয়ে
কাঁচা সোনা বাঙালী মেয়ে বিয়ে করবো…
সকাল দুপুর সাঁঝে সমতলের বাঁশ ঝাড়ে আমি
মুসলিম নারীদের সাথে উদাসীন সঙ্গমে মেতে রবো।”
কোন আদিবাসী পুরুষের এমন কবিতার অপমানটা হজম করতে পারবেন? সুবিধার কথা হলো কোন আদিবাসী তো দূরের কথা কোন বাঙালী লেখকই কোন বাঙালী মুসলিম নারীর জাতি ও ধর্মীয় পরিচয় উল্লেখ করে এমন কবিতা লেখার সাহস করবেন না। তাহলে শ্বাশত কোন সাহসে আদিবাসী নারীদের নিয়ে এই কবিতা লিখলেন? কে ওনাকে এই সাহস ও স্বস্তি দিলো? যে দেশে সংবিধান তার নাগরিকদের বাঙালী ছাড়া আর কোন জাতিগত পরিচয় স্বীকার করে না এবং ইসলাম ছাড়া আর কোন ধর্মকে রাষ্ট্র ধর্ম মানে না;
যে দেশে পাঠ্যপুস্তক অ-বাঙালীদের সাপ-ব্যাঙ খাওয়া, গাছে গাছে বানরের মতো বাস করা ‘জংলী’ পরিচয় এঁকে যায়; যে দেশে গণমাধ্যম আদিবাসী নারী ও ক্যুসিন দারুণ আবেদনময় ভোগের বস্তু হিসেবে উপস্হাপন করার লালসা ও রসনা দ্বারা তাড়িত হয়; যে দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম করা শিক্ষক তার শিক্ষার্থীদের মাঠকর্ম শেখান স্হানীয় নেতাদের ক্ষমতা ব্যবহার করে রাতের আসরে আদিবাসী নারীদের নাচতে বাধ্য করে; যে দেশে আদিবাসী নারী তার খুন ধর্ষণের কোন সুবিচার কোনদিন পায় না, যে দেশ আদিবাসীর নয় এবং আদিবাসীরাও যে দেশের নয় ; সে দেশে শাশ্বতের মতো মানুষেরা কবিতার কলমই ধরে আদিবাসী নারীর শরীর পাঁচ শূকরে কেনা যায়, উন্মুক্ত উপত্যকায় তাকে যখন তখন ভোগ করা যায়, খোঁপায় অনায়াসে ধোকাবাজী গোঁজা যায় সে ধৃষ্টতা ও রাষ্ট্রীয় আধিপত্য পুঁজি করে।
শুধু আদিবাসী নারীই নয়। ঠিক যেমন করে জালিম রাষ্ট্র ও তার প্রতিষ্ঠান পিতৃতাণ্ত্রিক মতাদর্শ ও চর্চা দিয়ে ‘অবাধ্য’ , কিংবা স্রোতের বিপরীতে চলা নারীদের ‘বেশ্যা’, ‘রাতের রাণী’ পরিচয়ে পরিচিত করে তেমনি শাশ্বত তার আরেক প্রেমের কবিতা -“আমার তৃষ্ণার্ত রোমিওদের প্রতি” -এ লেখেন “পাঁচশো পুরুষের সঙ্গে না শুয়ে ভাল অভিনেত্রী হতে পারেনি কেউ।”এমন একজন কুরুচিকর, ধর্ষকামী, মূর্খ, জাতের দেমাগ ও ব্যাটাগিরী দেখানো মানুষের কবিতার বই প্রকাশিত হয়। বৈভব প্রকাশনী তার বই ছাপিয়েছে। প্রকাশক পাপীয়া জেরীন এ বই-ই শুধু প্রকাশ করেননি বরং শাশ্বতের কবিতার সমস্যা যারা তুলে ধরেছেন উনি তাদেরকে ‘সাহিত্য-প্রতিবন্ধী’ বলেছেন। জাতি, নারী, শ্রেণী বিদ্বেষের পাশাপাশি উনি বিশেষভাবে স্বক্ষম মানুষদের ব্যাপারেও অসংবেদনশীল। পাপীয়া কিংবা শাশ্বত অদূর ভবিষ্যতে তাদের ভুলের জন্য ক্ষমা চাবেন কিংবা লজ্জিত হবেন অতোটা আমি আশা করি না। ক্ষমতা ও নির্বুদ্ধিতার সমন্বয় যেখানে ঘটে সেখানে ক্ষমা চাওয়ার মানসিকতা গড়ে ওঠে না। তাই এসব বই বারবার প্রকাশিত হয় নির্দ্বিধায়, বিক্রী হয় আমাদের মাঝেই।প্রান্তিক নারীর জীবন, লড়াই, এজেন্সিকে রাষ্ট্র যে পাটাতনে দাঁড়িয়ে খুবলে খায়, এই কবিতা, এই বই সেই পাটাতনকে আরও মজবুত করে। জুলুমের এই মাটি আর শক্ত হতে দিয়েন না। প্রেমের নামে এতোটা অপ্রেম, নোংরা পুঁজে ভরা লালসা কিনেন না।
Be the first to write a comment.