May be an image of 1 person and outdoors

চৈত্র সংক্রান্তি, চৈত্র মাস এবং একই সাথে ১৪২৮ বঙ্গাব্দের শেষ দিন। যদিও সবাই আগামিকাল নতুন বছর ১৪২৯ বরণ করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, কিন্তু চৈত্র সংক্রান্তি ঠিক মত পালন না করে নতুন বছর বরণ করা বোধ হয় ঠিক হবে না। শহরের মানুষ পয়লা বৈশাখের প্রস্তুতি নিচ্ছেন, কিন্তু গ্রামে চৈত্র সংক্রান্তি পালনের চর্চা সকল ধর্মের কৃষক পরিবারের মধ্যে বহু দীর্ঘকাল ব্যাপী জারি আছে। আমাদের দেশ সবুজে ঘেরা, নদী মাতৃক দেশ। নারীরা হাজার বছর ধরে প্রকৃতির সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রচনা করে আসছেন। এই চর্চার মধ্যে যে জ্ঞান এবং চর্চা সেটা এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে পরিবাহিত হয়ে চলছে। চৈত্র সংক্রান্তির দিনের মূল কথা হচ্ছে অনাবাদী এবং আবাদী ফসলের অংশবিশেষ (পাতা, ফুল, কাণ্ড বা শেকড়) সংগ্রহ এবং খাওয়া, সেগুলো নিজেদের বাড়ীর কাছের জমি, রাস্তা, নদী বা পুকুর পাড়, জলাশয় ইত্যাদী থেকে কুড়িয়ে আনা। বাজার থেকে কিনে এনে খাওয়া যায়, সেটাও কেউ নিশ্চয় কুড়িয়ে এনেই বিক্রি করে। কিন্তু কৃষক নারী নিজে চৈত্র সংক্রান্তিতে ঘরের পাশে আলান পালান মাঠের আনাচে কানাচে শাক কুড়াতে বেরোয়। নিয়ম আছে চৌদ্দ রকম শাক কুড়িয়ে এনে খাওয়া। ‘চৌদ্দ’ সংখ্যাটা প্রতীকী। এর কম বেশি হতে পারে। তবে এই দিনে কোন আমিষ (মাছ, মাংস, ডিম) খাওয়া হয় না, তবে ডাল খাওয়া হয়। আফসোস, শহরের খুব কম মানুষই বিষয়টি সেভাবে পালন করেন।

May be an image of outdoors

গ্রামের নারী প্রকৃতির সাথে খুব ঘনিষ্ঠ। অনাবাদী গাছ-গাছালী যা তারা নিজে লাগান নি, আপনা থেকেই হয়েছে তা নিয়ে তাদের জ্ঞান রয়েছে। এই জ্ঞান তিনি বই পড়ে নয়, জেনেছেন তার মা বা নানী-দাদীর কাছ থেকে। এর গভীরতা বোঝা যায় যখন দেখি মা শাক তুলতে গেলে সাথে চার-পাঁচ বছরের মেয়েটিও শাক তোলে এবং অন্য সময় মা চুলায় রান্না বসিয়ে মেয়েটিকে শাক নিয়ে আসতে বললে সে ঠিক শাকটি এনে দিতে পারে। চৌদ্দ রকমের অনাবাদী কুড়িয়ে আনা শাক যেমন হেলেঞ্চা, নেটাপেটা শাক, কচুশাক, তেলাকুচা শাক, থানকুনি, গিমা শাক, কলমিশাক, ঢেকি শাক, খেতাশাক, মোরগশাক, নুনিয়াশাক এবং তার সাথে থাকে মিষ্টি কুমড়া পাতা, লাউ শাক, পাট শাক ইত্যাদী। কিছু আবাদী ফসল যেমন মিষ্টি কুমড়া, লাউ, পাট আবাদ করা হয় ভিন্ন কারণে কিন্তু এক পর্যায়ে এর পাতা শাক হিশেবে খাওয়া হয় সেটাকেও গ্রামের নারীরা কুড়িয়ে পাওয়া হিশেবেই মনে করেন। কারণ এই শাক যারা আবাদ করেন না, তাঁরাও তুলে নিতে পারেন। কেউ আপত্তি করে না। গ্রামের মেয়ে, বউ, নানী বা দাদী শাক তুলতে যান দল বেঁধে।

May be an image of 1 person and outdoors

টাঙ্গাইলে্র গ্রামে নারীদের গাওয়া একটি গান –

শাক তুলবার গেছিলাম

উবুত হইয়া পড়ছিলাম

দেখলি ছেরি ধরলি না

ফালদা উঠলাম ডুলিতে

ডুলি করে কটমট

নওশা মিয়ার কোন ঘর

উচা-নিচা টিনের ঘর

হাত-পা ধুইবার খড়ম দেও

বদনা খানি পানি দেও

হাতে একটা রুমাল দেও।

এই গানের তালে তালে শাক তোলা হয়। তাদের ধারনা শাক তোলার সময় এগুলো বললে অনেক শাক তুলা যায়। গ্রামের মেয়েরা অল্প বয়স থেকেই মায়ের সাথে গিয়ে শাক তুলতে শিখে যায়। আজকাল মেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে, কিন্তু তাহলেও শাক তোলার প্রয়োজন হলে তারা শাক তুলে দিয়ে তারপর স্কুলে যায়। গ্রামের নারীরা শাক তোলেন স্বাস্থ্য এবং পুষ্টির প্রয়োজনে। শাকে ভিটামিন আছে এই কথা সবাই জানেন। এবং বিশেষ শাকের বিশেষ গুণ সম্পর্কেও তাঁরা ওয়াকিবহাল আছেন। যেমন গিমা শাক তিতা হলেও বাচ্চাদের খাওয়াতে হবে, এতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে। মুখে রুচি বাড়ে। মায়েরা বাচ্চাদের জন্যে একটু আলু-বেগুন মিশিয়ে রান্না করে খাওয়ান। বাচ্চারা খেতে না চাইলে নানা গল্প বলে ভুলিয়ে ভালিয়ে খাওয়াতে চেষ্টা করেন। থানকুনি খেলে গ্যাস হয় না, পেটের অসুখের জন্যে ভাল। তেলাকুচা পাতা ডায়াবেটিস নিরাময়ের জন্যে উপকারি। এবার রমজান মাসে চৈত্র সংক্রান্তি হচ্ছে। মুসলিম কৃষক পরিবারে দিনটি সেভাবে পালন করা হচ্ছে না। কারণ রোজার কারণে দিনে শাক রান্না বা খাওয়া হচ্ছে না, কিন্তু তাই বলে শাক খাওয়া হচ্ছে না তা নয়। ইফতার, রাতের খাওয়া এমনকি সেহরীতেও গ্রামের মানুষ শাক খাচ্ছেন। সেটার জন্যে তাদের যুক্তি আছে। সারাদিন রোজা রেখে খাওয়ার রুচি থাকে না, শরীরে বল পাওয়া যায় না, পেটে অসুবিধা হয় – এসব কারণে শাক দিয়ে তৈরি বড়া বা ভর্তা খেলে উপকার পাওয়া যায়।

তবে কিছু বিষয় লক্ষ্য করার মতো। গ্রামের মানুষ তার জ্ঞান অনুযায়ী যা পাবার কথা ছিল তা খুঁজে না পেলে আফসোস করেন। এখন চৌদ্দ রকম শাক পাওয়া কঠিন হয়ে যাচ্ছে। রাস্তাঘাট হয়েছে, বড় বড় দালান কোঠা হয়েছে, তাই অনাবাদী শাক শব্জি আর খুঁজে পাওয়া যায় না। সব শাক সব এলাকায়ও একইভাবে পাওয়া যায় না। টাঙ্গাইলে এবার গিমা শাক খুব ভাল পাওয়া গেছে কিন্তু পাবনা এবং নাটোরে এবার গিমা শাকের দেখা নাই। এই অঞ্চলে গভীর নলকুপ ব্যবহার করে অতিরিক্ত খরা সৃষ্টি হয়েছে যার কারণে অনেক শাক দেখা যাচ্ছে না। কুষ্টিয়া থেকে তথ্য নিয়ে জানলাম শীতের পর বৃষ্টি না হওয়ায় শাক খুব কম দেখা যাচ্ছে। বৃষ্টি হলে অনাবাদী গাছ-পালা লতাপাতা তর তর করে বাড়ে কিন্তু গাছ গজালেও পাতা টিকছে না, অর্থাৎ শাক পাওয়া যাচ্ছে না্‌ । জলবায়ূ পরিবর্তন তাই ভাবনার বিষয়। একই সাথে আধুনিক কৃষি, সার-কীটনাশকের ব্যবহার বেশি হলেও শাক পেতে অসুবিধা হয়, পাওয়া গেলেও খাওয়া যায় না। চৈত্র সংক্রান্তি আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় কোন ধরণের গাছ-গাছালি বা কোন জাত বা প্রজাতির অভাব ঘটছে, কৃষক নারী সেটা বুঝতে বুঝতে পারেন। নয়াকৃষিতে তাই চৈত্র সংক্রান্তিকে প্রকৃতির ‘অডিট’ অর্থাৎ কৃষি ব্যবস্থার হিশাব নিকাশ গণ্য করা হয়। এই হিশাবনিকাশ কৃষি চর্চায় কোথায় দোষ ঘটেছে সেটা ধরিয়ে দিয়ে সংশোধনের কথা মনে করিয়ে দেয়। চৈত্র সংক্রান্তি কৃষির ভুল সংশোধনের দিন। এই চৈত্র (১৪২৮) মাসে যেসব শাক পাওয়া গেছে তার কিছু ছবি দিলাম। তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন ফাহিমা খাতুন লিজা (টাঙ্গাইল), আজমিরা খাতুন (পাবনা-নাটোর), ডলি ভদ্র (কুষ্টিয়া)। ছবি তুলেছেন আবুল কালাম, কিছু এবার তোলা আর কিছু আমাদের সংগ্রহ থেকে নেয়া।

লিখা ও ছবি: ফরিদা আক্তার। লেখক নারী গ্রন্থ প্রর্বতনার পরিচালক ও স্বত্বাধিকারী।