কার কোন মাপের, কোন ঢংয়ের শরীর ভালো লাগবে সেটা ব্যক্তিগত ব্যাপার। একিসাথে সকলকিছুকে পছন্দ করে গ্রহণ করা হয়তো আপনার পক্ষে সম্ভব না। কিন্তু পছন্দ-অপছন্দের বাইনারী অপজিশনের বাইরেও অনেক ব্যাপার থাকতে পারে, যেমনঃ পছন্দ করা, অপছন্দ করা, পছন্দ না করলেও শ্রদ্ধা বজায় রাখা, ঘৃণা করা, অশ্রদ্ধা করা এবং বহুবিধ। কিন্তু অন্যের শরীরের আকার, রঙ, দৈহিক অবয়ব নিয়ে আপনি যখন ঘৃণা বা অপছন্দের শব্দ ছড়াবেন সেটা মারাত্বক বডি শেমিংয়ের দিকে যায়।
নিজের স্থুল শরীর নিয়ে মানসিক ক্রাইসিসে ভোগেন এমন একজন একবার আমাকে কটাক্ষ করে বলেছিলেন সিনা টান করে (সোজা বাংলায় বুক উঁচা করে) হাঁটি বলে পুরুষরা আকৃষ্ট হয়। এটা বডি শেমিং নয়? হ্যা, এটাও বডি শেমিং। যে তথাকথিত সুন্দরের খাতায় পড়ে, তাকে দেখেও যদি বলেন ‘সুন্দর বলে চাকরি পায়’, ‘শরীর দেখাতে পারে বলে প্রমোশন হয়/সাফল্য আসে’ এসবকে কোন নামে ডাকবেন?কয়েকদিন আগে এক ডিনারের নিমন্ত্রণ পেলাম, এক বন্ধুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম কোন ধরণের ড্রেস পরলে আমাকে ভালো লাগতে পারে। ইচ্ছাকৃত ‘ভালো লাগা’ বা ‘খারাপ লাগা’ শব্দটা ব্যবহার করেছিলাম, স্রেফ ইচ্ছাকৃত। কেনো? পরে বলছি। বন্ধুটির উত্তর ছিলো- ‘এ কী ধরণের প্রশ্ন!তুমি যা পরবা তাতেই ভালো লাগবে! এ প্রশ্নের উত্তর নেই আমার কাছে।’ তখন তাকে বলেছিলাম, জীবনে এতবার শুনেছি কোন রঙ আমাকে খারাপ লাগে, কোন কাপড় অন্যকে ভালো লাগে কিন্তু আমাকে লাগে না, গায়ের রঙ কালো বলে কিভাবে চলা উচিত, বডি শেইপ ঠিক নেই বলে টাইট না পরে ঢোলা পরা উচিত এমন বহু বহু কিছু।
স্রেফ বন্ধুটির মানসিকতা জানার তাগিদে প্রশ্নটি করেছিলাম, নিরাশ করেনি সে। এ সমাজ থেকেইতো আমরা উঠে আসি, তাই না? আমাদের নিজেদের নিয়ে একধরণের ইনফেরিওর কমপ্লেক্সিসিটি পর্যন্ত তৈরি হয়ে যায়। অন্যদিকে মাথায় গেঁথে যাওয়া এই ছকে বাকিদেরও ফেলতে থাকি। সুন্দর অসুন্দরের সংজ্ঞাটা সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশের বাইরে তৈরি হয় না। স্বীকার করে নেন, আপনাদের এই পরিবেশেই মারাত্বক ঘাটতি আছে আর ওখানে সকল জ্ঞানী বুদ্ধিজীবীরাও উৎপন্ন হয়। এজন্য ঘন ঘন আমাদের সামনে আমাদের আইডল, আইকনদের চেহারাটা খোলসা হয় ইদানিং। কে কতটুকু নিজেদেরকে এ ছক থেকে বের করতে চান, কতটুকু চর্চা করেন, কতটুকু প্রকাশ-অপ্রকাশের ভেতর রাখেন সেটুকু দিয়েই তার বোঝাপড়া, প্রগতিশীলতা, শিক্ষা, মানসিকতা বিচার করা সম্ভব।
তথাকথিত সুন্দর হলে ক্লিভেজ দেখাবে, নিতম্ব দেখাবে, যাদের ‘সুন্দর’ ক্লিভেজ, নিতম্ব, মাসল নেই তারা ঢেকে রাখবে কেননা তারা কুৎসিত, তাদের দেখলে চোখ সরাতে ইচ্ছে করে- এ জিনিস চোখের সামনে দেখে নিতে পারা কষ্টকর। পৃথিবীর প্রতিটা মানুষের তার নিজস্বতা নিয়ে প্রকাশিত হবার স্বাধীনতা থাকা উচিত, এর চেয়ে সুন্দর আর কিছুই হতে পারে না। এর জন্যইতো লড়াই করি, নাকী? প্রিয় তসলিমা, আপনি দীর্ঘবছর নির্বাসিত। আপনার সেই সাহসিকতা সেই সংগ্রামকে অস্বীকার করি না। যেভাবে আপনার বর্তমান মানসিকতাকেও অস্বীকার করার উপায় নেই। এও অস্বীকার করার উপায় নেই, শ্রদ্ধা নির্ভর করে ব্যক্তির কাজের ওপর, অন্ধভাবে শ্রদ্ধা বা সম্মান করাকে অন্ধবিশ্বাসের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যায়। আপনার নির্বাসিত জীবন ও সে সংগ্রামের পাশে আছি। আর এই যে আপনার রূপ, যা দেখিয়ে চলেছেন একের পর এক, তার প্রতি মারাত্বক অশ্রদ্ধা চলে এসেছে।বিঃদ্রঃ যাদের এ পোস্ট ভালো লাগবে না তারা এড়িয়ে যান স্বাচ্ছন্দ্যে। তুলসী গাছের নিচে সন্ধ্যায় প্রদীপ দিন, ভক্তির আতিশয্যে কপালে কালো চিহ্ন ফেলে দিন।
লেখক ফাহমিদা হানিফ ইলা, বর্তমানে নরওয়ের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী
Be the first to write a comment.