দেখেন পরীমণি বা হেলেনা জাহাঙ্গীরের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা ছিলো সরাসরি রাষ্ট্রের সাথে নাগরিকের কনফ্লিক্ট। এইখানে সরাসরি রাষ্ট্রের ট্যাক্স পেয়িং দুইজন নাগরিকের নাগরিক অধিকার খর্ব করা হয়েছে। এবং এই নাগরিক অধিকার খর্ব করাকে সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা দেয়ার জন্য রাষ্ট্রীয় বাহিনী যে কৌশলটা নিয়েছে সেটা হচ্ছে, সামাজিক যে নৈতিকতার মানদ্ন্ড আছে সেই মানদন্ড অনুযায়ী এই দুইজন নাগরিকের বিরুদ্ধে অপরাধ সাজিয়েছে। মদ, নাচগান করা এবং বহু পুরুষের সাথে সম্পর্ক ।
খেয়াল করেন তিনটা বিষয়ের সাথেই সামাজিক নীতি নৈতিকতা জড়িত। এর সাথে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, অর্থ পাচার, দুর্নীতি, খুন বা অন্যের নিরাপত্তার জন্য হুমকি বা এই জাতীয় কোন ক্রিমিনাল অ্যাক্ট কিন্তু যুক্ত না। তার মানে রাষ্ট্র এইখানে কি করলো? সমাজের মধ্যে যে নৈতিকতার কনফ্লিক্ট বিদ্যমান আছে ওইটাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করলো। ব্যবহার করলো নিজের অথবা রাষ্ট্রের ক্ষমতাশীল মহলের স্বার্থ বা উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্য। এই পয়েন্টটা খুব গুরুত্বের সাথে একটু বুঝেন।
অনেকে কন্সপিরেসি থিওরি হিসেবে অনেক কিছু হাজির করছেন, কিন্তু সেইটা দেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের দেখার দরকার বা জানার দরকার নাই। মামলায় যে ভাবে বলা হবে বা বলবে আমদেরকে আসলে সেভাবেই দেখতে হবে এবং তার উপরই আসলে আমাদের আলোচনা করতে হবে।
উপরে ঘটনা দুইটার মধ্যে ম্যাল প্র্যাকটিস কতগুলা হয়েছে দেখেন –
১. নাগরিকের নাগরিক অধিকার লঙ্ঘন।
২. ক্ষমতাশীল ব্যাক্তিদের আন্তঃকোন্দলের অংশ হিসেবে রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে পেশী শক্তির মতো বাবহার করা ।
৩. এবং সবচেয়ে ঘৃণিত যে কাজটা হয়েছে সমাজে বিদ্যমান নৈতিকতার কনফ্লিক্টকে উষ্কে দেয়া এবং সেইটাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যাবহার করা ।
যে কথাটা দিয়ে শুরু করেছিলাম, তো বিষয়টা ছিলো রাষ্ট্রের নাগরিক অধিকার বনাম রাষ্ট্রের ক্ষমতার মধ্যে কনফ্লিক্ট। রাষ্ট্র চাইবেই শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতো করে এই কনফ্লিক্টটাকে সামাজিক দ্বন্দ্ব হিসেবে হাজির করতে। এখন আমরা যখন আসলে নাগরিক অধিকার বনাম রাষ্ট্রক্ষমতার এই কনফ্লিক্টকে সামাজিক কনফ্লিক্ট হিসেবে হাজির করছি তখন আসলে সমাজের মধ্যে এই কনফ্লিক্টটা কি কি ভাবে ট্র্যান্সমিট হচ্ছে খেয়াল করেন –
শিল্পী সমিতি, মিডিয়া কর্মী এরা একে অপরকে দোষারোপ করায় ব্যাস্ত হয়ে গেছে, পরীমণিকে ডিজওউন করছে । ভালো নারী মন্দ নারীর সংজ্ঞা দাঁড়াচ্ছে এবং একদল আরেক দলকে ডিজওউন করছে, নারী পুরুষের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি হচ্ছে, চক্রান্ত তত্ত্বে বিশ্বাসী এবং মামলায় বিশ্বাসীর মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি হচ্ছে , সাধারন মানুষ এবং শিল্পী সমাজের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি হচ্ছে ।

খেয়াল করেন যেটা আসলে ছিলো নাগরিক এবং রাষ্ট্রের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব সেইটাকে ট্র্যান্সমিট করে সমাজের মধ্যে বহুবিধ দ্বন্দ্ব হিসেবে ছড়িয়ে দেয়া হলো । এখন এইটা করে লাভ কি বা কেন করা হলো ?
কারণ আপনি যখন নিজেকে নাগরিক ভাবছেন তখন ধনী, গরিব, নারী পুরুষ, শিল্পী, শ্রমিক, ভালো নারী, মন্দ নারী সবাই সমান এবং রাষ্ট্রের নাগরিক। নাগরিক শব্দটা বলামাত্র আপনার প্রাপ্ত অধিকারে কিন্তু কোন ভেদ নাই। এবং তখন আমি আমরা যৌথ এবং একতার শক্তি প্রয়োগ করতে পারি। আমরা যখন নাগরিক হিসেবে যৌথ তখন রাষ্ট্রের সাথে আমাদের বারগেইন করার ক্যাপাসিটি তৈরি হয় এবং আমরা বারগেইন করতে পারি । সমস্যাটাকে খুব সুনির্দিষ্ট ভাবে চিহ্নিত করতে পারি। সব চেয়ে বড় বিষয় নাগরিক হিসেবে তখন আমরা সরাসরি রাষ্ট্রকে প্রশ্ন করতে শুরু করি, রাষ্ট্রকে জবাবদিহিতার আওতায় আনার জন্য আওয়াজ তুলতে থাকি। কাজেই যখনই এই কনফ্লিক্টটাকে সামাজিক হিসেবে দেখানো গেলো তখনই আসলে রাষ্ট্রের সকল অপকর্ম চাপা পড়ে গেলো। রাষ্ট্রকে জবাবদিহিতার আওতায় আনাতো দুরকি বাত!
ওই জন্যই সংকটের ধরণ মানে, কোনটা সামাজিক সংকট এবং কোনটা রাষ্ট্রীয় সংকট এইটা চিহ্নিত করতে পারাটা অসম্ভব জরুরী। না হলে কোনটাকে সামাজিক আন্দোলনে সমাধান করব আর কোনটার রাজনৈতিক আন্দোলনে সমাধান আসবে এই ভেদ আমরা করতে পারব না।
বিষয়টাকে অনেকে এভাবে দেখতে চাচ্ছেন যে, পরীমণি নাসির সাহেবের ইজ্জত লুটেছে অতএব নাসির সাহেব ক্ষমতার জোর দেখিয়ে রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে ব্যাবহার করে তার ইজ্জতলুটার শোধ নিয়েছে! রাষ্ট্রের পুরা একটা নিরাপত্তা বাহিনী, যারা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ জনগণের জানমালের নিরাপত্তা দেয়ার, তারা যে একজন ব্যক্তি বা একটা গোষ্ঠীর অঙ্গুলি হেলনে চলল বা চলছে এইটা ওনাদের কাছে কোন ইস্যুই না ! বিষয়টা শুধু পরীমণির না বিষয়টা সামগ্রিক নাগরিক অধিকার, নাগরিক নিরাপত্তার !
সমাজের মানুষের মধ্যে কনফ্লিক্ট নাই, বর্ণবাদ বা বৈষম্য বা মিসোজিনি নাই এই রকম কোন দেশ পৃথিবীতে একজিস্ট করে না। রাষ্ট্রের কাজ হলো এই সমস্ত কনফ্লিক্টকে রিজলভ করা, নিউট্রালাইজ করা। ভালো রাষ্ট্রগুলা এই কাজটাই করে। আর হারামী রাষ্ট্র সমাজের মধ্যে বিদ্যমান এই সমস্ত কনফ্লিক্টকে উষ্কে দেয়, লালন করে, পালন করে। হারামী রাষ্ট্র এই সমস্ত কনফ্লিক্টকে উষ্কে দিয়ে জিইয়ে রেখে নিজের স্বার্থ হাসিল করে।
Top of Form
Be the first to write a comment.