ড. সলিমুল্লাহ খানের সুইডেন প্রবাসী প্রাক্তন বউ শেখ তাসলিমা মুন এর লেখা “যদ্যপি আমার গুরু-পতি” বইটা এক বসায় পড়ে ফেললাম। পাশের বাড়িতে ঝগড়া লাগলে যেমন ঘণ্টার পর ঘণ্টা নিরলস দাঁড়িয়ে থেকে তাদের ঝগড়া দেখতে ভাল্লাগে তেমনি ভাল্লাগে কারো টপ টপ করে উপরে উঠে যাওয়া বা ঘর ভেঙে যাওয়া গল্প পড়তে! ভালো যেহেতু লাগে কি আর করা! ফলে এক বসায় পইড়া ফেললাম মুন-সলিমের দাম্পত্য জীবনের ক্রাইসিস। এর আগে মৈত্রেয়ী দেবী’র ন’হন্যতে পইড়া খুবই ভাল্লাগছিল, তাসলিমা মুন এর গদ্যটাও ভালো লাগছে। টাচি, ঝরঝরা।
কেও বিপদে পড়লে যেহেতু সহায়তা করার একটা সুযোগ পাওয়া যায়, আর সহায়তা করার সুযোগে সে ব্যক্তির কাছে নিজেকে গ্রেট হিসেবে উপস্থাপন করা যায় ফলে মানুষের বিপদে আমি খুশি না হলেও বিষয়টাকে আমি আমার মহত্ত্ব প্রকাশ করার অপরচুনিটি হিসেবে দেখি। আর মানুষের সুদিনে আমি কাছেই ঘেঁষি না। ছোটসময়ে একটা বাগধারা শিখেছিলাম ‘দুধের মাছি’ মানে সুসময়ের বন্ধু। এই বাগধারাটি আমার মায়েরও খুব পছন্দ ছিল, কাওকে নিজের দু:সময়ের কথা বলতে গেলে আমাকে কোট করে মা বলতো, ‘আমার ছেলে বলে এরা সব দুধের মাছি’। আমার খুব আনন্দ হতো তখন। আমি নিজে কখনোই দুধের মাছি টাইপ মানুষ না। কারো কোন হেল্প লাগলে খেটেখুটে করে দিই, হেল্প লাগলে হেল্প চাই কিন্তু তাদের ভালো সময়ে বলা চলে আমি তাদের এভয়েড করার চেষ্টা করি। আমার কাছে মানুষের ভালো সময়ের কোন মূল্য নাই, ভালো সময়গুলো ফাঁপা, লাইট, ও সাময়িক বিভ্রান্তির মতো একটা ব্যাপার মনে হয় আমার কাছে। ভালো সময় অনেকটা মদ খেয়ে মাতাল হওয়া আনন্দমুখর সময়ের মতো। ভালো সময়ের নেশা কেটে যায় খুব দ্রুত আর দুনিয়ার বুকে এতিম করে ছেড়ে দেয়।
এতো কথা বললাম শুধু একারণেই যে ঘর ভেঙে যাওয়ার গল্প বলেই হয়তো টানটান উত্তেজনা নিয়ে আমি পুরোটা বই শেষ করতে পারলাম! এত এত ঘর টিকিয়ে রাখা গর্বিত মানুষের ভীরে ঘর টেকানোর অনন্ত সংগ্রামের মুখে একমুঠো বালি ছুড়ে মেরে নিশ্বাস ফেলার জন্য প্রচুর ঘর ভাঙা গল্পের প্রয়োজন আমাদের। ঘর ভাঙা গল্পগুলো আমাদের সকলের মনে শক্তি জোগায়। তাসলিমা মুনের লেখার ভিতর দিয়ে যে ক্রাইসিস আমার চোখে ধরা পড়ছে সে ক্রাইসিসের সাথে আমি ব্যক্তিগত ভাবে খুবই পরিচিত। মানে আমার মনে হইছে সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমিও এরকম ক্রাইসিসের ভিতর দিয়ে গেছি কয়েকবার। যদিও আমি সলিমের মতো কোন পরিণতির দিকে যাই নাই, বহু আগেই ভবিষ্যৎ ভেবে থমকে দাঁড়িয়েছি। আমার চাইতে আমাকে আর কে বেশি জানে! অনেক সময় বাস্তবতা যতটুকু না ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে, তার অধিক ভয়ংকর হয়ে ওঠে ভবিষ্যৎ চিন্তা। আমি একেকটা সম্পর্কের পরিণতি দেখতে পেতাম ভয়ংকর এক মধ্যবিত্তিয় শৃঙ্খলতায়, আর সেটাকে মানসিক ও অর্থনৈতিকভাবে টিকিয়ে রাখার আমৃত্যু পেরেশানি ও সেই পেরেশানিতে নিজের খাবি খাওয়ায়।
বইটা পড়ে যা বুঝতে পারি একটা ঘোরের ভিতর দিয়ে তাসলিমা আর সলিম একটা সম্পর্কে জড়িয়ে যায়। সেই ঘোরটা আরেকটা ক্রাইসিস থেকে বাচতে নিজেদের ইচ্ছাতেই তৈরি করা। অনেকটা ঠাট্টা করতে করতে পাগল হয়ে যাওয়ার মতো! ঘোরের সময় সলিমেরও তাসলিমা ও তাসলিমার আগের ঘরে ছেলেকে ভালো লাগে, আর তাসলিমাও সলিমের দুনিয়া আর গুছিয়ে কথা বলার পার্থক্য ধরতে পারেনা। আমিও একজন গুছিয়ে কথা বলতে পারা প্রেমহীন প্রেমিকের অভিনয়কারী। আমার কথায় এতো সম্মান, এতো প্রজ্ঞা, এতো সরলতা থাকে ভালো না লাগার কোন কারণ নাই। কোন কথায় কে আনন্দ পেতে পারে আর কে দু:খ পেতে পারে সেটা যেহেতু কিছুটা হলেও জানি। ফলে মুখের কথায় যে দু:খ দেয়া সে দু:খ আমরা দেই না, আমাদের বুঝমান ভাষাই তো সকল আত্মার এক্সপেক্টেড ভাষা। কিন্তু এই গুছানো ভাষার মধ্যে আমি কি বাস করি? দেখা যায় আমার সম্পর্ক তৈরি করার গুছানো ভাষা আছে, আমি নাই, আমি হেটে হেটে চলে গেছি আমার সেই “আমিকে আবিষ্কার ও প্রতিষ্ঠা করতে থাকার” ভাষার দুনিয়ায় যেখানে তোমার তেমন কোন জায়গা নেই। সেখানে রয়েছে কেবল লেয়ারের পর লেয়ার চিন্তায় জড়িয়ে যাওয়া ভাষার অগণিত ফ্যানা! সেখানে প্রেমিকা নাই, সন্তান নাই, সংসার নাই।
আমি ছোট মানুষ কিন্তু আমার আর সলিমের ক্যারেক্টার অলমোস্ট সেইম সম্পর্কের ক্রাইসিসের জায়গাটায়। ফলে আমি আরো ডিপলি বুঝতে পারি সলিমের ক্রাইসিস। তাসলিমাও অনেকখানিই বুঝতে পারছেন সলিমরে। বইটা পইড়া মনে হইছে সলিম মূলত একা থাকার মাঝে কম্ফোর্ট খুঁজে ফেরা মানুষ। একা মানে নিজের মধ্যে তৈরি করে নেয়া জগতে মুক্ত পাখির মতো বাচতে চাওয়া মানুষ। বই পড়া, লেখা, লেকচার দেওয়া এর বাইরে সলিম খানের জীবন কঠিন। সে কঠিনেরে সলিম ডরায়, যে ডর ছফারও ছিল। এই ডর কি আব্দুর রাজ্জাক থিকা পাইছি আমরা? মানে নিজের মধ্যে থাকতে চাওয়া, নিজের কম্ফোর্ট জোনের সাথে কোনভাবে কম্প্রোমাইজ না করা, সাহিত্য/রাজনীতি/দর্শনকে সবসময় সেন্টারে রাখা, আর কোনদিকে মনোযোগ দিতে না চাওয়া, ইগো, সাংসারিক রেস্পন্সিবিলিটি নিতে না চাওয়া, মনের ভেতর একটা কলোনিয়াল যন্ত্রণা পুষে রাখা যেখান থেকে ওয়েস্টার্ন লাইফস্টাইল, বড়লোকের ভদ্রলোকি ভালোবাসতে না পারা/আপন করে নিতে না পারা…এরকম অনেক ইস্যু আছে যেখান থেকে এসব সম্পর্ক ওয়ার্ক করেনা। অন্তত আমার জায়গা থেকে আমি এইটুকু বুঝতে পারি।
সলিম যখন তাসলিমার আগের ছেলেকে মারধোর করে তখনকার ঘটনাটা কী? ছেলেটা বলে লাইব্রেরীর পরিবেশটা ‘স্পুকি’ লাগে। সলিমের মাথা আউলায়া যায়! সলিম আবার জিগায়, কী লাগে? ‘স্পুকি’। অইদিকে সলিমের “সন্তানে”র মতো ভাই-বইনেরা কষ্টে মইরা যাইতেছে আর এইদিকে উনার নাকি স্পুকি লাগে! মানে এরকম একটা ব্যাপার ঘটতে পারে। সলিম তুলনা দিতেছে তোমার সংসার চালাইতে লাগে দের হাজার পাউন্ড আর আমি আর আমার বিশাল পরিবার চলি ৬-৭০০ পাউন্ডে। সলিমরে বাড়ি থেকে কল দিলেই সলিম অন্ধকার দেখতে পাইতো। আমরা দেখতে পাই বই পড়া, লেখা, লেকচার দেয়া এর বাইরে সলিম আর কোন কাজই ঠিকঠাক কইরা উঠতে পারেনা। সলিম এইসব কিছু থেকে পালাইয়া বাচতে চাইছে। নিজের বাড়ির রেস্পনসিবিলিটি তারে এমন প্যারা দিছে সে সংসার, পরিবাররে ডরাইতে শুরু করছে। সে এইগুলির কাছ থেকে অনেক দূরে সইরা গিয়া কেবল স্থির চিত্তে পড়তে চাইছে, লিখতে চাইছে আর বলতে চাইছে। সলিম এইটা জানার পরেও সম্পর্কে জড়াইছে আর পরে ব্যালেন্স করতে পারে নাই।
আমি আরকি বুঝি যে আমি ব্যালেন্স করতে পারবো না। ফলে আমার কথা বা আমারে কারো ভালো লাগতেছে বইলা আমি সম্পর্কে জড়াইয়া পরি না আর। কারণ দেখা গেলো আমার একটা বই পড়তে বা একটা সিনেমা দেখতে বা একটা তর্ক করতেই বেশি ভাল্লাগতেছে। প্রেমিকারে লইয়া এইটা অইটা প্ল্যান করুম অই জগতেই আমি আর নাই! ভাত-কাপড় কোনরকম হইলেই হইলো, প্যারা নাই। কিন্তু ভাত-কাপড়ের দুনিয়ায় হারাইয়া যাইতে চাই না একেবারেই। একা থাকারে পছন্দ করি, একা একটা আবছা আলোয় সেজদা দিয়া পইড়া থাকতে ভাল্লাগে। এই আমার গুছানো ভাষা ভাল্লাগলে কি হবে, সেখানে তো আমি থাকি না আসলে!
লেখাঃ শেখ সাদ্দাম হোসেনের ফেসবুক টাইমলাইন থেকে
Be the first to write a comment.