
[ ২০১৯ এর শেষদিকে আফগানিস্তান নারী বিপ্লবী সংগঠন RAWA- এর সংগঠক সামিয়া ওয়ালিদের সাক্ষাৎকার নেয় কুর্দি নারী আন্দোলনের কিছু কর্মী। সাক্ষাৎকারটা প্রথম জার্মান ভাষায় কুর্দিস্তান রিপোর্টে প্রকাশিত হয়, পরে কুর্দি নারী আন্দোলন কর্মীদের ওয়েবসাইট Komun Academy তে ইংরেজি ভার্সন প্রকাশিত হয়। বাংলা সাক্ষাৎকার ইংরেজি থেকে ভাষান্তর ]
১. আপনি কি দয়া করে আমাদেরকে RAWA -এর ইতিহাস এবং মিশন সম্পর্কে বলতে পারেন? আপনাদের সংগঠন যখন প্রথম গঠিত হয়েছিলো তখন আফগান মহিলাদের অবস্থা কেমন ছিল? সমাজে আপনাদের ভূমিকা কি? আপনারা কিভাবে সংগঠিত করেন?
মহিলাদের বিপ্লবী সংগঠন (RAWA) আফগানিস্তানের পুরনো নারী সংগঠন যা স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য লড়াই করে। RAWA- এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মীনা যিনি ১৯৭৭ সালে অল্প বয়সে কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু মহিলা শিক্ষার্থীদের সহায়তায় এই গ্রুপটি গঠন করেছিলেন। গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ারের রক্তপিপাসু মৌলবাদী দলের সহায়তায় KHAD (KGB- আফগানিস্তান শাখা) প্রতিনিধি কতৃক ১৯৮৭ সালে পাকিস্তানের কোয়েটায় মীনাকে হত্যা করা হয়। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ৩০ বছর। যা অন্যান্য সমিতি থেকে RAWA কে আলাদা করে- তা হল এই যে, আমরা একটি রাজনৈতিক সংগঠন। যখন RAWA প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন আফগানিস্তানে সোভিয়েত পুতুল সরকার এবং পরে সোভিয়েত দখলদারিত্ব সরাসরি প্রতিষ্ঠিত হয়। এসময় মীনা অনুভব করেছিলেন যে স্বাধীনতা, মুক্তি এবং ন্যায়বিচারের সংগ্রাম নারীর অধিকারের লড়াইয়ের সাথে অবিচ্ছেদ্য। মীনার মৃত্যুর পর RAWA আজ অবধি আফগান ইসলামী মৌলবাদী এবং তাদের আন্তর্জাতিক সমর্থকদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।
RAWA এখনও আফগানিস্তানের বেশিরভাগ অঞ্চলে গোপনে কাজ করে এবং বিপুল সমস্যার সম্মুখীন হয়। ভয়াবহ অপরাধের রক্তাক্ত অতীতসহ যুদ্ধাহত জিহাদি নেতারা বর্তমান সরকার এবং পার্লামেন্টের নিয়ন্ত্রণে আছে এবং আফগানিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলে তাদের আলাদা রাজত্ব রয়েছে। আফগানিস্তানের সিও আবদুল্লাহ আবদুল্লাহ এই জিহাদি নেতাদের মধ্যে একজন, যারা শোরাই নিজারের অপরাধী চক্রের অন্তর্গত। এটা আমাদের জন্য বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি করে, এই ঠগগুলো আমাদের সবচেয়ে বড় শত্রু যারা আমাদের কাজে বাধা দিতে এবং ক্ষতি করতে দ্বিধা করে না। আফগানিস্তানের অন্যান্য অংশে যেখানে তালেবান মৌলবাদীরা নিয়ন্ত্রণে আছে, সেখানে RAWA একই নিপীড়নের মুখোমুখি হয়। আমাদের সকল সদস্য সুরক্ষার জন্য ছদ্মনাম ব্যবহার করে এবং আমরা কখনোই আমাদের কাজ নিয়ে প্রকাশ্যে যেতে পারি না। এই প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও স্থানীয়দের সাথে আমাদের যোগাযোগ এবং এই অপরাধীদের প্রতি তাদের বিদ্বেষ আমাদের সমর্থনে রূপান্তরিত হওয়ার কারণে দেশের অধিকাংশ অঞ্চলে আমাদের রাজনৈতিক কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া এখনও সম্ভব।
রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে রয়েছে ম্যাগাজিন ও নিবন্ধ প্রকাশ করা; সাথেসাথে নারীদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো যাতে তারা আমাদের সংগ্রামে যুক্ত হয়। আমরা আফগানিস্তানের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যুদ্ধবাজদের হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, চাঁদাবাজি এবং অন্যান্য অপরাধ সংগ্রহ ও নথিভুক্ত করি। আমাদের সামাজিক কার্যক্রমে নারীদের শিক্ষা প্রদান (শুধু সাক্ষরতার হার নয় বরং তাদের অধিকার এবং সেগুলো কীভাবে অর্জন করা যায় সে বিষয়ে সামাজিক ও রাজনৈতিক সচেতনতা) জরুরী সহায়তা প্রদান, এতিমখানা তৈরি করা এবং স্বাস্থ্য সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালনা করি।
২. পিতৃতন্ত্র নিয়ে আপনার বিশ্লেষণ কী? এটা কোনো উপায়ে রাষ্ট্র, সাম্রাজ্যবাদ এবং পুঁজিবাদের সাথে যুক্ত হয়ে যায়?
সমাজে বিশেষ করে রাজনীতিতে নারীর ভূমিকা মুছে ফেলার জন্য সারা বিশ্বে প্রতিক্রিয়াশীল সামন্তীয়, পুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী সরকার দ্বারা পিতৃতন্ত্র ক্রমাগত সমর্থিত ও লালিত হয়। সকল প্রকারের সরকার, বিশেষ করে সামন্তবাদী সরকারগুলো আফগানিস্তানের মত সাম্রাজ্যবাদী উপনিবেশবাদীদের সাথে আবদ্ধ, নারীদের শক্তি ও চেতনাকে তাদের আধিপত্যের জন্য মারাত্মক হুমকি হিসেবে দেখে এবং এর বিকাশ ও সচেতনতা বন্ধ করতে বিভিন্ন উপায় ব্যবহার করে। এই ধরনের সরকারকে স্বভাবতই গণবিরোধী মনে করা হয়, তারা জনগণ ও তাদের সংগ্রামের উপর নিপীড়ন করেই টিকে থাকতে পারে, নারীদের দমনই তাদের প্রধান লক্ষ্য। সামন্ততান্ত্রিক কুসংস্কার ও সংস্কৃতিকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে তারা নারীদেরকে তাদের সকল অধিকার থেকে বঞ্চিত করে এবং অর্ধেক সমাজকে পঙ্গু করে দেয় আর এর থেকে কোনো সংগ্রাম ও প্রতিরোধের আশ্বাস দেওয়া যায় না। এই সরকারগুলি কখনোই নারীর মুক্তির জন্য কোন পদক্ষেপ নেয় না, বরং তারা নারীদের শৃঙ্খলাবদ্ধ করে। আজ আফগান নারীদের অবস্থা আগের চেয়ে অনেক বিপর্যয়কর। আমেরিকা “নারীর অধিকার” এর অজুহাতে আফগানিস্তানে আক্রমণ করেছিল কিন্তু বিগত আঠারো বছরে আমাদের নারীদের উপর তারা যেটা নিয়ে এসেছে তা হল- সহিংসতা, হত্যা, যৌন সহিংসতা, আত্মহত্যা এবং অন্যান্য দুর্ভাগ্য। আমেরিকা আফগান নারীদের সবচেয়ে ঘৃণ্য শত্রু ইসলামী মৌলবাদীদের ক্ষমতায় এনেছিল এবং আমাদের ভুক্তভোগী নারীদের বিরুদ্ধে অমার্জনীয় বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। গত চার দশক ধরে এটা তাদের কৌশল। জিহাদি, তালেবান ও ISIS- এর মতো মৌলবাদী নারীবিদ্বেষী গ্রুপগুলোকে পুষে বাস্তবিকভাবে আমেরিকাই আমাদের নারীদের উপর অত্যাচার করেছে।
৩. আপনি কোন উপায়ে নারীর মুক্তিকে দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের সাথে যুক্ত করেন?
আমরা সাম্রাজ্যবাদী, উপনিবেশবাদী, ইসলামী মৌলবাদী এবং পুতুল সরকার থেকে মুক্ত হওয়ার মধ্যে দিয়ে আফগান নারীদের মুক্তি দেখতে পাই। নারীর স্বাধীনতা সরাসরি তাদের যন্ত্রণা ও দুর্ভাগ্যের মূল কারণ, দখলদার এবং তাদের অভ্যন্তরীণ পরগাছাদের বিরুদ্ধে নারীর প্রতিরোধ ও বিপ্লবী সংগ্রামের সাথে জড়িত। আমরা বিশ্বাস করি যে, মৌলবাদী ও হত্যাকারী এবং দুর্নীতিগ্রস্ত গোষ্ঠী যারা হত্যা, লুটপাট এবং অন্যান্য অপরাধ ও বিশ্বাসঘাতকতার সাথে জড়িত তাদের বিদেশী শক্তি ছাড়া সহায়তার কোন উৎস নেই এবং সেটা ছাড়া তারা একটি দিনও টিকবে না। নারীদের রাজনৈতিক চেতনা জাগ্রত করে এবং তাদের দুর্ভাগ্যের মূল কারণ হিসেবে এই লোকদের সামনে তুলে ধরে, আমরা তাদের বিরুদ্ধে একটি স্থিতিস্থাপক সংগ্রামে নারীদের সংগঠিত করতে চাই যেহেতু তারা তাদের বিদেশী প্রভুদের দ্বারা তৈরি হয়েছিলো।
৪. আফগান মহিলাদের অধিকার বিশেষত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের আফগানিস্তান আক্রমণের ন্যায্যতা ও বৈধতা প্রদানের জন্য সহায়ক হয়েছে। কোন উপায়ে এই বিষয়টি আপনার নারীদের সক্রিয়তাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে?
জনগণ, বিশেষ করে নারীদের বিপ্লবী ও রাজনৈতিক সংগ্রামকে বিমুখ করার ক্ষেত্রে হুকুমদাতা হচ্ছে মার্কিন। গত আঠারো বছরে, পুরো আফগানিস্তানে সবচেয়ে বেশি নারী-বিরোধী উপাদানগুলিকে সমর্থন করা এবং এই উপাদানগুলি অস্পৃশ্য থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করার পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সরকার, অন্যান্য প্রতিষ্ঠান, এনজিও, সুশীল সমাজ এবং মহিলাদের মধ্যে শিক্ষিত নারীদের একটি নেটওয়ার্ক চালু করেছে। এর একটি দ্বৈত উদ্দেশ্য আছে। প্রথমত, এটি এই মহিলাদের ব্যবহার করে আফগান নারীদের বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে বিশ্বকে ধোঁকা দেয় এবং তাদের ক্লান্তিকর যুদ্ধে এটা অর্জন হিসেবে উপস্থাপন করে। দ্বিতীয়ত, এই ধরনের শিক্ষিত মহিলাদেরকে তার শাখার অধীনে নিয়ে, এটা নিশ্চিত করে যে তারা বিপ্লবী সংগ্রামে যোগদান করবে না, এবং এইভাবে মূল্যবান মানুষদের আন্দোলনে নারীদের বঞ্চিত করবে। সম্প্রতি, “উইমেনস নেটওয়ার্ক” থেকে বিকৃত, ক্ষমতাবান ক্ষুধার্ত মহিলাদের একটি দল আফগান মহিলাদের “প্রতিনিধি” হিসেবে গুলবুদ্দিন হেকমাতিয়ারের সাথে দেখা করে। গুলবুদ্দিন অন্যতম রক্তপিপাসু মিথ্যাবাদী অপরাধী, যিনি তার যৌবনকালে মহিলাদের মুখে অ্যাসিড নিক্ষেপ করার জন্য সুপরিচিত এবং এই মহিলারাই খ্যাতি, ক্ষমতা এবং অর্থের জন্য তাদের মিথ্যাবাদী ইসলামী দলকে সুন্দর রূপ দিতে তার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন। ফওজিয়া কূফি, হাবিবা সারাবি, সিমা সমর এবং অন্যান্যরা জিহাদি এবং তালেবান অপরাধীদের সাথে অর্থ ও ক্ষমতার বিনিময়ে বসেন এবং বিশ্বাসঘাতকতার সাথে নিজেদেরকে আফগানিস্তানের নিপীড়িত মহিলাদের প্রতিনিধি হিসেবে পরিচয় দেন। এই মহিলারা তালেবানদের দ্বারা অন্য মহিলাদের ওপর বেত্রাঘাত ও পাথর ছোঁড়া উপেক্ষা করে এবং সরকারের দলে যোগ দেওয়ার পর মহিলাদের জন্য যে তারা “ভালো” কর্মসূচি করছে সেদিকে ইঙ্গিত করে! এই নারীরা ক্ষমতাসীন শক্তির পাশে আমাদের ভুক্তভোগী নারীদের বিশ্বাসঘাতক হিসেবে দাঁড় করিয়েছে। আফগানিস্তানের নারীদের প্রতি তাদের কোনো আকুতি বা দরদ নেই।
৫. কেন RAWA তার কার্যক্রম ইউরোপ/পশ্চিমা দেশগুলিতে সরানোর পরিবর্তে আফগানিস্তান বা এ অঞ্চলে রাখার সিদ্ধান্ত নিলো? পশ্চিমা প্রতিষ্ঠানগুলোর পৃষ্ঠপোষকতায় আফগানিস্তান এবং গ্লোবাল সাউথের অন্যান্য দেশে ক্রমবর্ধমান এনজিও-য়াইজেশন সম্পর্কে আপনি কী ভাবেন?
RAWA বিশ্বাস করে যে এটি শুধুমাত্র জনগণের সমর্থন নিয়ে একটি শক্তিশালী আন্দোলনে পরিণত হতে পারে এবং এই সমর্থন আফগানিস্তানে অবস্থান এবং কাজ করার মাধ্যমে আসে, এমনকি পরিস্থিতি নরকের মতো হলেও। মানুষ শুধুমাত্র বিপ্লবী সংগঠনগুলিকে বিশ্বাস করে যারা তাদের অনুশীলনে তাদের পাশে থাকে এবং দেশের অভ্যন্তরে সক্রিয় থাকে। আমাদের অভিজ্ঞতা দেখিয়েছে যেসব সংগঠন আফগানিস্তান থেকে শিকড় কেটে ইউরোপ এবং অন্যান্য দেশে চলে গেছে তারা লজ্জাজনকভাবে বিলীন হয়ে গেছে। RAWA দীর্ঘদিন ধরে বেঁচে থাকার এবং সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হল, রক্তক্ষয়ী পরিস্থিতি সত্ত্বেও আমরা আফগানিস্তানে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
এনজিও আমাদের দেশে সাম্রাজ্যবাদের মেরুদণ্ডের একটি বড় অংশ। আমরা বিশ্বাস করি যে, এনজিও-য়াইজেশন ব্যাপারটি আফগানিস্তানের পুতুল সরকার গঠনের মতো প্রায় বিপজ্জনক। আফগানিস্তানের এনজিওগুলো প্রায় সবই যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য পশ্চিমা শক্তির অর্থায়নের মাধ্যমে গঠিত। তারা আফগানিস্তানের ভবিষ্যতের পুতুল সরকার গঠনের জন্য তরুণদের নিয়োগের জন্য একটি আবাসস্থল দিচ্ছে যেখানে একটি আধুনিক, গণতান্ত্রিক সরকারের চেহারা থাকবে এবং এই শক্তির আরও বেশি অনুগত পরগাছাদের পরিবেশন করার জন্য তাদের ক্ষমতার ব্রেইনওয়াশ করা হবে। এনজিওগুলি আমাদের যুবকদের বিপুল বেতন এবং বিদেশে বসবাস করার সুযোগ দিয়ে তাদের মাথা থেকে জাতীয়তাবাদ এবং বিপ্লবী সংগ্রামের চেতনা নিঃশেষ করে। এটা সুপ্রতিষ্ঠিত যে এই এনজিওগুলির কেউই জনগণ এবং মহিলাদের সেবা করে না এবং তাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য গোপন করার জন্য কেবল “পুনর্গঠন” এবং “মানুষের জন্য সাহায্য” স্লোগান দিচ্ছে।
৬. আফগানিস্তান গত কয়েক দশক ধরে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির দ্বারা আক্রমণ, শোষণ এবং মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এটি বিশেষ করে মহিলাদের প্রভাবিত করেছে। যদিও RAWA তালেবানের নিয়মতান্ত্রিক যৌন সহিংসতাকে ন্যায়বিচারের সামনে রাখার জন্য প্রচারাভিযানের নেতৃত্ব দিয়েছে, আমরা দেখেছি যে মিথ্যাবাদী দুর্নীতিবাজরা মার্কিন সমর্থন নিয়ে উচ্চ রাজনৈতিক পদে উঠেছে। আপনি যুদ্ধে যৌন সহিংসতা কিভাবে বিশ্লেষণ করেন? আফগানিস্তানে যুদ্ধের হাতিয়ার হিসেবে কোন উপায়ে এবং কার সহায়তায় যৌন সহিংসতা ব্যবহার করা হয়েছে? এবং আপনার দৃষ্টিভঙ্গিতে আফগান মহিলাদের জন্য ন্যায়বিচার কেমন দেখাচ্ছে?
ইতিহাসের অধিকাংশ সংঘর্ষের মতো আফগানিস্তানের যুদ্ধ ও সংঘাতে নারী ও শিশুরাই প্রধান লক্ষ্যবস্তু হয়েছে। তারা মৌলবাদী গোষ্ঠীর সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ টার্গেট হয়েছে, যারা প্রায় তিন দশক ধরে আমাদের জাতিকে ধ্বংস করেছে। ১৯৯২ সালে সোভিয়েতদের পরাজয়ের পর আমেরিকা, সৌদি আরব এবং পাকিস্তান কর্তৃক সৃষ্ট, লালিত -পালিত ও সমর্থিত জিহাদিরা ধর্ষণ ও অন্যান্য ধরনের যৌন সহিংসতায় সাধারণ হয়ে ওঠে। গুলবুদ্দিন হেকমাতিয়ার, বুরহানউদ্দিন রব্বানী, আবদুল রব রসুল সায়াফ, করিম খলিলি, আহমদ শাহ মাসুদ এবং আবদুল রশিদ দস্তুমের নেতৃত্বে জাতিসত্তার ধারায় বিভক্ত জিহাদি যুদ্ধবাজদের বিভিন্ন দল, কাবুলবাসীকে ঘরে ঘরে লুটপাট ও ধর্ষণ করেছে। মহিলাদের অপহরণ করে বেসমেন্ট এবং খালি ভবনে রাখা হয়েছিলো এবং বারবার ধর্ষণ ও নির্যাতন করা হয়েছিলো। গোষ্ঠীর সদস্যরা একটি নির্দিষ্ট এলাকা ত্যাগ করার পর বেশিরভাগকেই শেষ পর্যন্ত বিকলাঙ্গ করে হত্যা করা হয়েছিলো। এই ধরনের মহিলাদের বিবরণ ছিলো ভয়াবহ এবং দুঃস্বপ্ন।
ইসলামী মৌলবাদী উপাদান এবং অন্যান্য মার্কিন মদদপুষ্ঠ বর্তমান সরকারের সম্পূর্ণ বিনাশের মাধ্যমেই নারীদের জন্য ন্যায়বিচার অর্জন করা সম্ভব। মহিলাদের বিরুদ্ধে জড়িত ইসলামী মৌলবাদী যুদ্ধাপরাধী দলের নেতাদের বিচার ও শাস্তি হওয়া দরকার। একবার আমাদের নারীরা এই কাজটি সম্পন্ন করলে আমরা বলতে পারি যে ন্যায়বিচার হয়েছে।
৭. যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোতে, যুদ্ধের সময় এবং শান্তির সময় নারীরা প্রায়ই শিকার হয় এবং চুপ থাকে। মনে হচ্ছে তাদের সংস্থা, ইচ্ছা শক্তি এবং রাজনৈতিক দাবিগুলি সংঘাতের সব পর্যায়ে, এমনকি শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায়ও সরিয়ে রাখা হয়েছে। বিরল ক্ষেত্রে, মহিলাদের একটি টোকেনিস্টিক পদ্ধতি কান্নাকাটি, অসহায় ভুক্তভোগী ও নিজেদের জন্য কথা বলতে অক্ষম। শান্তি ও ন্যায়বিচারের জন্য আফগান নারীদের ভূমিকা কী?
আফগান নারীদের জন্য শান্তি কেবল ন্যায়বিচার দ্বারা অর্জন করা যায় এবং আফগানিস্তানকে বিদেশী দখল এবং ইসলামী মৌলবাদ থেকে মুক্ত করেই ন্যায়বিচার অর্জন করা যায়। এই বিশ্বাসঘাতক ও হত্যাকারীদের ক্ষমতা থেকে অপসারণ করা উচিত এবং নারীরা যে শান্তি, সমৃদ্ধি এবং প্রকৃত গণতন্ত্রের জন্য ন্যায়বিচার চাচ্ছে এটাই হচ্ছে তাদের নিপীড়ন ও শাস্তি। সচেতন নারীদের সংগঠিত সংগ্রামের মাধ্যমে এটি অর্জন করা সম্ভব।
যুক্তরাষ্ট্র, তালেবান, কিছু নারীসহ বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট আফগান ব্যক্তির মধ্যে যে শান্তি আলোচনা চলছে, তা আমাদের নারীদের ক্ষতস্থানে লবণ ছিটানোর সমতুল্য। নারীদের প্রতিনিধিত্ব করার দাবী করা মিথ্যাবাদী নারীরা তাদের সবচেয়ে খারাপ শত্রু এবং তারা নারীদের সবচেয়ে বিপজ্জনক শত্রুদের সাথে আলোচনা করছে যাতে তাদের যা আছে সেটার থেকেও বেশি ক্ষমতা এবং অর্থ নেওয়া যায়।
৮. আপনি কোন ধরনের সমাজের জন্য সংগ্রাম করছেন? এখানে এবং এখন আপনার কল্পনাগুলি উপলব্ধি করার জন্য আপনি কী প্রচেষ্টা করছেন?
আমরা একটি স্বাধীন, মুক্ত এবং গণতান্ত্রিক সমাজের জন্য সংগ্রাম করছি যা সামাজিক ন্যায়বিচারের স্তম্ভগুলিতে পরিচালিত হয় এবং যেখানে নারী ও পুরুষ প্রতিটি ক্ষেত্রে সমান। এ পথটা দীর্ঘ ও কঠিন। মহিলাদের সংঘবদ্ধ ও সংগঠিত করা একটি বিশাল কাজ, কিন্তু আমরা বিশ্বাস করি এই মূল্যবোধগুলি অর্জনের জন্য অন্য কোন বিকল্প নেই।
৯. নারীর স্বাধীনতা আপনার এবং আপনার আন্দোলনের কাছে কী বোঝায়?
আমাদের জন্য নারীর স্বাধীনতা হচ্ছে আত্মনির্ভরশীলতা, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের উপর নির্মিত সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ। প্রতিটি ক্ষেত্রে পুরুষদের সাথে সম্পূর্ণ সমতা। এই স্বাধীনতা ও সমতা সরাসরি রাজনীতি এবং সমাজের সাথে জড়িত। যেখানে নারীর বিরুদ্ধে গণতন্ত্র ও সামাজিক ন্যায়বিচার বাস্তবায়িত হয় সেই ক্ষেত্রে দখলদার এবং মৌলবাদী নারীবিদ্বেষী ভাইরাস মুক্ত সমাজ-ই সহিংসতার শৃঙ্খল ভেঙে দিতে পারে এবং নারীদের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ও অধিকারের সমন্বয় করতে পারে।
১০. কুর্দি নারী আন্দোলন হিসেবে, আমরা জানি যে RAWA আন্তর্জাতিকতাকে প্রতিরোধ ও মুক্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হিসেবে মূল্যায়ন করে। রোজাভায় নারী বিপ্লবের সমর্থনে আফগানিস্তানের নারীরা রাস্তায় নেমে এসেছে। রোজাভা বা কুর্দিস্তানে মহিলাদের সংগ্রাম সম্পর্কে আপনার চিন্তা কি? আমরা একে অপরের কাছ থেকে কি শিখতে পারি?
কুর্দিস্তানের সিংহীদের সংগ্রাম ও আত্মত্যাগ আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা এবং শক্তির উৎস। ISIS এবং অন্যান্য মধ্যযুগীয় অপরাধীদের বিরুদ্ধে তাদের সংগ্রাম আমাদের বিশাল শিক্ষা দিয়েছে। আমরা জানি যে, পৃথিবীতে কোনো শক্তিই নেই হোক তা ISIS কিংবা তার অন্য কোনো পরাশক্তি সমর্থক অথবা এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশগুলো জনগণের সত্যিকারের প্রতিরোধের মুখে দাঁড়াতে পারবে না। আমরা লক্ষ লক্ষ বার জানি যে, নারীদের অংশগ্রহণ ছাড়া কোন সংগ্রাম সফল হতে পারে না। আমাদের স্বপ্নের সমাজ অর্জনের জন্য যে ত্যাগ স্বীকার করতে হবে তা আমরা বুঝতে পারি। যখন আমরা আফগানিস্তানে ISIS নাম শুনি তখন আমরা এটিকে কুর্দিস্তানের দৃঢ়চেতা ও সাহসী নারীদের সাথে যুক্ত করি, আমাদের দেশে যে সন্ত্রাস চলছে তার সাথে করিনা। আমরা বিশ্বাস করি তারা পরাজিত এবং একটি সত্যিকারের মহিলাদের আন্দোলনের মুখে তারা কোনো সুযোগই পাবে না। যদিও আমরা স্পষ্টভাবে এই বিষয়গুলো বিশ্বাস করি যে যেহেতু আমরা এই পথে পা রেখেছি, এই সংগ্রাম আমাদের বিশ্বাসের একটি উজ্জ্বল প্রমাণ।
১১. স্বাধীনতার জন্য নারীদের বিশ্বব্যাপী সংগ্রামের ক্ষেত্রে, আপনি পুরুষতন্ত্র এবং সহিংসতা ও নিপীড়নের অন্যান্য ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সাধারণ লড়াইয়ে আমাদের একসাথে কাজ করার জন্য কি উপায় আছে বলে মনে করেন?
RAWA আমাদের অভ্যন্তরীণ সংগ্রামের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসাবে স্বাধীনতা-সচেষ্ট, স্বাধীনতা-সংগ্রামী, গণতান্ত্রিক এবং প্রগতিশীল সংগঠন ও দলগুলির সাথে আন্তর্জাতিক সংহতি বিশ্বাস করে। আমাদের সংগ্রাম কুর্দি জনগণের সংগ্রামের সাথে মিলে যায় কারণ আমাদের অধিকাংশ শত্রুর প্রকৃতি একই রকম। আমরা সাম্রাজ্যবাদ এবং তাদের মৌলবাদী ভাড়াটেদের বিরুদ্ধে লড়াই করছি। এই মুহুর্তে, আমাদের অভিজ্ঞতা এবং পাঠগুলি ভাগ করতে হবে যাতে আমরা আরও কঠিন এই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যেতে পারি।
বাংলা অনুবাদকের নোটস
১. আব্দুলাহ আব্দুলাহ সদ্য উৎখাত হওয়া সরকারে আফগানিস্তানের High Council for National Reconciliation (HCNR) পদে ছিলেন। এর আগে তিনি ২০১৪ থেকে ২০২০ আফগানিস্তানের সিও ছিলেন। ২০১৪ -এর নির্বাচন নিয়ে আশরাফ ঘানির সাথে সমঝোতার অংশ হিসেবে সিও পদটি তার জন্য বিশেষভাবে সৃষ্টি করা হয়।
২. এখানে occupation- কে দখলদারিত্ব বলে অনুবাদ করা হয়েছে। এরচেয়ে যুতসই কিছু পাওয়া যাচ্ছিলো না।
৩. ইংরেজি NGO-ization কোনো ধরনের পরিবর্তন না করে বাংলা এনজিও-য়াইজেশন রাখা হয়েছে।
আবু ইউসুফ শাকিল, শিক্ষার্থী – জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
Be the first to write a comment.