একজন কন্যা শিশু জন্মগ্রহণ করার প্রক্রিয়াটিই এমন যেন কোন অন্যরকম ”কিছু”র জন্ম হচ্ছে! যেন এটি কোন মানব সন্তান নয়! এটি এমন একটি বোঝাপড়া যা কিনা সমাজেরই তৈরী এবং এর চর্চা যেন শতভাগ জায়েজ। এটি ’স্বাভাবিক’ ও ‘মঙ্গলময়’ এমন একটি বিশ্বাস ও একে আষ্টেপিষ্টে ধরে রাখার নানা বিধান অনাদিকাল থেকেই সমাজে চলে এসেছে। এভাবেই সমাজপতিদের তৈরী করা ছকে যেমন চলা শুরু হয় একজন কন্যা শিশুর পথ চলা, পাশাপাশি সমাজের অন্যদের চিন্তাজগতও কাঠামোকৃত করা হয় যে তারা কিভাবে ও কোন ছাচে ফেলবে একজন ‘কন্যা শিশু/নারী’ কে।
আমরা এমন একটি বৈশ্বিক সমাজে বাস করি যেখানে সমাজ নির্ধারণ করে দেয় আমরা কি চিন্তা করবো, কিভাবে চিন্তা করবো কিংবা কে, কাদের নিয়ে, কখন চিন্তা করবো ইত্যাদি। সবকিছু বাদ দিয়ে যদি শুধুমাত্র কোন একটি নামকে উদাহরণ হিসেবে বলি, তাহলে দেখা যায় যে, এই নামকে কেন্দ্র করে আমরা ধরেই নিচ্ছি কে কোন ধর্মের, তার লিঙ্গীয় পরিচয়, সে ধনী কি দরিদ্র ইত্যাদি নানা বিষয়! একটা সময় ছিল যখন পরিচারক/পরিচারিকাদের নাম পরিবর্তন করে দেয়া হতো। কেন? কারন ’চাকর শ্রেনীর’/’দরিদ্র শ্রেনীর’ এমন বাহারি নাম থাকা যাবে না। তখন আরও মনে করা হতো, মেয়েরা আবার চিন্তা করতে পারে নাকি? চিন্তা করতে পারে শুধু পুরুষেরা! নারীরা রান্না করে খাওয়াবে আর পুরুষেরা বসে নিশ্চিন্তে চিন্তা করবে,ঘরের বাইরে কাজ করবে! ঘরের মধ্যে থাকা নারী আবার রসুই ঘরের বাইরে কিছু জানে-বোঝে নাকি!!
নারী আবার যুদ্ধ করবে? কিংবা কোন আন্দোলনে সামিল হবে? তবেই তারা হয়ে যায় ‘নষ্ট’ নারী!! তখন নারীর এই সক্রিয় অবদানকে বোঝাপড়ার চেয়ে তাকে ‘নষ্ট’ হিসেবে উপস্থাপন করা সমাজের কাছে যেন জরুরী হয়ে ওঠে!!। মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদান বহুমাত্রিক হলেও বাংলাদেশের মূলধারার ইতিহাসে নারীর মুক্তিযোদ্ধা ইমেজের পরিবর্তে তাঁর ধর্ষিত ইমেজটিকেই কেবল প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। কেবল বাংলাদেশেই নয়, ইতিহাসজুড়ে, সারা পৃথিবীতে, আমাদের সামষ্টিক চেতনায় যোদ্ধার ভূমিকা পুরুষের জন্যই তুলে রাখা। সার্বিকভাবে গণমাধ্যমে যুদ্ধ উপস্থাপনবিষয়ক তাত্ত্বিক কাঠামো (del Zotto, 2002; Fröhlich, 2002; Stabile and Kumar, 2005)এই মর্মে সাক্ষ্য দেয় যে, যুদ্ধকে বৈধতা দেওয়ার জন্য সেনাবাহিনী এবং রাজনৈতিক নেতৃত্ব নারীর শান্তিকামী অথচ দুর্বল ও অসহায় এবং পুরুষের শক্তিশালী ও ক্ষমতাবান ইমেজকে ব্যবহার করে। তাই যখন গেরিলা চলচ্চিত্রের ‘বিলকিস’ কে গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দেখানো হয়, সেটা বেশিরভাগ মানুষই মেনে নিতে পারেননি কিংবা একজন নারীকে মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রে ‘অসহায়’ এর পরিবর্তে মুক্তিযোদ্ধা, তাও আবার গেরিলা হিসেবে উপস্থাপন করে স্বাধীনতার বহু বছর পর নারীর যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহনের আরেকটি প্যাটার্নকে স্বীকার করে নেয়া হয়।
অন্যদিকে, ভারতের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন তথা সিএএ প্রসঙ্গ উঠলেই সামনে আসে বিলকিস বেগম ওরফে ‘শাহিনবাগের দাদি’র নাম। পুলিশের চোখ রাঙানি, প্রশাসনের ভ্রুকুটি সত্ত্বেও নিজের অবস্থান থেকে একচুলও নড়েননি অশীতিপর এ বৃদ্ধা। হার না মানার এই মানসিকতাই তাকে সারা বিশ্বের কাছে আদর্শ করে তুলেছে। সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ), জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি) এবং জাতীয় জনসংখ্যা পঞ্জি (এনপিআর) বিরোধী আন্দোলনে ভারতের রাজধানী যখন তেতে ওঠে, সেই সময় খবরের শিরোনামে উঠে আসেন বিলকিস। দীর্ঘ আড়াই মাস ধরে শাহিনবাগে অবস্থান বিক্ষোভে শামিল হওয়া মহিলাদের মুখ হয়ে উঠেছিলেন তিনি। তার জেরে বিশ্বের ১০০ জন সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বের তালিকাতেও উঠে আসেন তিনি। অথচ, ব্যক্তি এখনও তার বোঝাপড়া কিংবা চোখে দেখার বা সমাজের শেখানো বুলির বাইরে গিয়ে কিছু ভাবতে পারেনা!
বোঝাপরার সেই ধারা কিন্তু এখনও রয়ে গিয়েছে!! ব্যক্তি হিসেবে আপনি মনে করছেন আপনার বাড়ির সাহায্যকারীর কিংবা গ্রামের কোন নারী অথবা গৃহিনীর কোন চিন্তা-ভাবনা করার ক্ষমতা নেই!! এই যে স্টেরিওটাইপ করা হয়, তার কাঠামোকরণ ও চর্চাও কিন্তু ব্যক্তিভেদে, লিঙ্গভেদে ভিন্ন হয়ে থাকে। ঠিক তেমনি ’বিলকিস’ নামটি শুনে/পড়ে আপনার প্রথমেই কি মনে হয়, কার ছায়া মনে আসে? সেই প্রতিটি নারীরই আসলে নিজস্বভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা রয়েছে; রয়েছে কন্ঠস্বর; শুধু নেই বলবার/শোনাবার পরিসর। একজন নারী/পুরুষ যখন ধরেই নেয়, যে নারী শিক্ষিত নয়/ চাকরী করছে না/গ্রামে থাকে ইত্যাদি নানা প্রকারের হন, তাদের কোন আলাদা করে ভাবনা থাকে না, বলবার থাকে না, এটেই হলো স্টেরিওটাইপ করে ফেলা, গন্ডিতে বেঁধে ফেলা।
যাদের বিলকিস নাম নিয়ে জানতে চেয়েছি তারাই বলেছেন যে, এই নাম শুনলে মনে হয় ’গ্রামের কোন মেয়ের’/গার্মেন্টস/বাসায় কাজ করে’ এমন কারও নাম! কারও কাছে বিলকিস শোষিত কোন নারীর/ গৃহিনীর প্রতিচ্ছায়া। একেকজনের কাছে ‘বিলকিস’ একেকটি ভাবনা। আর আমাদের কাছে ‘বিলকিস’ সেই নারীটি যার কন্ঠস্বর রয়েছে,নিজস্ব ভাবনা রয়েছে; হোক না তিনি গ্রামের কিংবা শহরের; ধনী কি দরিদ্র কিংবা আরও শতেক সামাজিক নির্মাণের প্রকার। আমরা বিশ্বাস করি,পৃথিবীর প্রতিটি নারীরই রয়েছে পাবলিক ও প্রাইভেট পরিসরকে বিশ্লেষণ করার কিংবা দেখার জন্য স্বতন্ত্র চিন্তাশক্তি; রয়েছে তার প্রতিদিনের অভিজ্ঞতাকে বিচার-বিশ্লেষণ করার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি; এখন যদি বলা হয় যে, নারী তো এমনিতেই তেমন চিন্তাভাবনা করতে পারে না, তারওপরে যদি তিনি হন একজন ’শিক্ষিত’ নয় এমন নারী তাহলে তারা আবার বিচার-বিশ্লেষন করতে পারে নাকি? পারেন। পারেন বলেই যে অশিক্ষিত নারীটির দিকে আঙ্গুল তুলছে শিক্ষিত সমাজ তিনিই তার অল্প মাসিক টাকায় কিভাবে সংসার চলবে সেই ছকটি কষতে পারেন, যাকে গৃহিনী বলে ’গাল’ দিচ্ছেন তিনিই সংসারের প্রতিটি গতিবিধি পর্যালোচনা করেই দারুন টাইম ম্যানেজমেন্টের মধ্য দিয়ে ২৪/৭ প্রতিজনের চাহিদা পূরণ করছেন বৈকি কিংবা যে গার্মেন্টস কর্মীকে আপনি অবহেলাভরে দেখছেন তিনিই কিন্তু প্রতিনিয়ত লড়াই করে,ওভারটাইম খেটে নানা প্রতিকূলতার মাঝে টিকে থাকার ছক কষতে পারেন!!
তাই আমি বা আপনি মেনে না নিলেই, আমার বা আপনার চিন্তাধারার সাথে না মিললেই তাদের কিংবা সমাজের শতেক না বলতে পারা ‘বিলকিস’দের স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি বাতিল হয়ে যায় না; আর তাই বিশ্বাস করুন কিংবা না করুন, মানুন কিংবা না মানুন; Bilkis- has a point of view.
ছবি গল্প কথন
১. ছবি গল্পের অনেক ছবি ইন্টারনেট থেকে নেয়া। ছবির প্রমানসহ স্বত্ত্বাধিকারী হিসেবে নিজেকে দাবী করলে পোর্টাল কৃতজ্ঞতার সাথে তার নাম উল্লেখ করে দিবে। অথবা অনুমতি না দিলে পোর্টাল সেটি তাৎক্ষনিকভাবে সরিয়ে নিবে।
২.ছবি গল্পে ছবির সাথে সাথে ভ্রমণ অভিজ্ঞতাও প্রকাশ করা হবে। তবে তা অবশ্যই নারীর নিজের ভ্রমণ অভিজ্ঞতা অথবা নারীর সাথে সম্পৃক্ত ভ্রমণ অভিজ্ঞতা হতে হবে।
৩.ভ্রমন মানে কি শুধু দেশ-বিদেশের বাহারি-বিখ্যাত স্থানগুলো দেখা, ছুটিতে থাকা আর রিল্যাক্স করা !! নাকি এটা হলো সেই জার্নি, মানে আজ থেকে কালকের দিনটিতে পাড়ি দেয়া, জীবনের একটি পর্যায় থেকে অন্য পর্যায়ে পাড়ি দেয়া কিংবা বাড়ি থেকে বের হয়ে ফিরে আসা কিংবা রান্না না পারার সময় থেকে পাকা রাঁধুনি হবার সময় পর্যন্ত পুরোটাই ভ্রমন!! আর এই পাড়ি দেয়ার প্রতিটি মুহুর্তেই কত অভিজ্ঞতা, ভাবনা, প্ল্যান বাক্সবন্দি করি আমরা। সেই সকল ভ্রমণ অভিজ্ঞতা স্বাচ্ছন্দ্যে বিলকিস পোর্টালে লিখে পাঠিয়ে দিন।
পোর্টালের নীতিমালাঃ
- পোর্টাল যেকোন ধরনের ঘৃণামূলক বক্তব্য, মতামত ও আক্রমণাত্মক বক্তব্যের তীব্র বিরোধিতা করে। এধরনের কোন লেখা পোর্টাল প্রকাশ করতে ইচ্ছুক নয়।
- ব্যক্তি আক্রমণাত্মকপূর্ণ বা ধর্মীয় বিদ্বেষপূর্ণ কোন ধরনের লেখাও প্রকাশ করা পোর্টালের নীতি বিরোধী।
- যেকোন লেখকের ব্যক্তিগত জীবন ও কর্মকান্ডের সাথে পোর্টালের কোন সম্পৃক্ততা নেই।
- লেখার বক্তব্য ও মতামত লেখকের একান্ত নিজস্ব ভাবনা। এর কোন দায় পোর্টাল নিবে না।
- পোর্টাল ভিন্ন মতামতের ওপর শ্রদ্ধাশীল।
Comments are closed for this post.