খোলা স্টেশনে শত শত মানুষের উপস্থিতিতেই একদল ক্ষুব্ধ নারী-পুরুষ এক তরুনীর ওপর হিংস্র আক্রমনে উদ্যত। অভিযোগ…তরুনীর গায়ের পোশাক নিয়ে। নরসিংদী রেল স্টেশনে নারীর ওপর আক্রমনের ঘটনার ভিডিওটি যতবার সামনে এসেছে, ভীতি-আশংকায় হতবিহবল হয়েছি। প্রতিটি সমাজেই পোশাক-পরিধেয়ের কিছু অলিখিত মানদন্ড থাকে। আর থাকে সেই মানদন্ড মেনে চলার অদৃশ্য সামাজিক অনুশাসন, যাকে আমরা বলি সোস্যাল নরমস। আমরা সেইসব নরমস মেনে চলতে বাধ্য হই, অভ্যস্ত হই, কারণ আমরা সমাজের সকলের মধ্যে গ্রহণযোগ্য হতে চাই। দীর্ঘদিনের অভ্যস্ততার মধ্য দিয়ে সামাজিক এই অনুসশাসন ব্যক্তির মধ্যে অজান্তেই সহজাতভাবে আত্মিকৃত হয়। এর জন্য প্রতিদিন সমাজকে লাঠিসোটা নিয়ে ব্যক্তির ওপর চড়াও হতে হয় না; কিন্তু যদি হয় তাহলে বুঝতে হবে সংকট অন্য কোথাও জমছে!কোনো সোস্যাল নরমসই চিরস্থায়ী নয়।

একদিকে আমরা আমাদের প্রতিদিনের অভ্যস্ততার ভেতর দিয়ে নরমস পুনঃউদপাদন করি আবার নরমস পুনর্গঠনও হয়। নারীর পোশাক নিয়ে জেন্ডার মানদণ্ড নির্ধারণের ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। একই সাথে খেয়াল করা জরুরী, বৃহত্তর সমাজের ভেতরেও আমরা অসংখ্য ছোট ছোট সমাজ-গোষ্ঠীতে বিভক্ত—যাদের প্রত্যেকের আবার দর্শণ, মূল্যবোধ, চিন্তা-চর্চা, সামাজিক-অনুশাসনের নিজস্ব ধরন আছে। নারীর পোশাক-জীবন-চলাফেরা নিয়েও বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যকার মূল্যবোধ-চর্চার মধ্যে বিস্তর পার্থক্য আছে। এই পার্থক্য নিয়েই আমাদের একই সমাজে পথ চলতে হয়, যার জন্য পরস্পরের প্রতি রেসপেক্ট রেখে সহিষ্ণু সহবস্থান অনিবার্য শর্তের মধ্যে পড়ে। সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের সমাজে ধর্ম-নারীপ্রশ্ন নিয়ে চিন্তা-চর্চার বিভাজন অসিহষ্ণুতার পর্যায়ে পৌঁছেছে, যা আশংকাজনক। বিশেষতঃ নারী প্রশ্নে এক ধরনের ‘প্রগতিশীল’-রক্ষণশীল বিভাজন তীব্র হয়েছে।

নরসিংদীর রেল ষ্টেশনে পোশাক নিয়ে অনেকে মিলে নারীকে যে হেনস্থা করলো সেটা নিরীহ সামাজিক অনুশাসন নয়, এর মধ্যে নারী-বিদ্বেষই মূল উপাদান। কিন্তু এই নারী বিদ্বেষের মূল শুধু পুরুষতান্ত্রিকতার মধ্যে না। এখানে যুক্ত আছে রক্ষণশীল-‘প্রগতিশীল’ আইডিনটিটির দ্বন্দ্ব, যেটার বোঝাপড়া ছাড়া পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে নারীদের কমন সলিডারিটির ক্ষেত্র প্রস্তুত করা সম্ভব না। ফলে যা ঘটলো, সেখানে প্রতিক্রিয়া হিসেবে পাল্টা বিদ্বেষ কোনো সমাধানের পথ নয়। আমাদের বিদ্যমান রাষ্ট্র-সরকার এধরনের বিভাজন-বিদ্বেষ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ, বরং উলটো সরকার প্রত্যক্ষে-পরোক্ষে এই বিভাজনকে উসকে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। ফলে আমাদের দায়িত্ব অনেক। একদিকে প্রয়োজন বিভাজনকে উসকানোর অপতৎপরতার বিরুদ্ধে সজাগ থাকা, অন্যদিকে প্রয়োজন সমাজের সকল অংশের নারীদের মধ্যে এংগেজমেন্ট বাড়ানো। কারও মত-পথের প্রতি বিদ্বেষ ছড়ানো নয়, চাই বিভিন্ন মতের মধ্যে সহিষ্ণু সংলাপ।

May be an image of 1 person and indoor
লেখক : শ্যামলী শীল, শিক্ষক সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়