আমি আফসানা সুমী। গুটিপোকার প্রতিষ্ঠাতা ও ডিজাইনার। ২০১৪ সালের ২৩ জানুয়ারি যাত্রা শুরু করে গুটিপোকা। পরবর্তীতে সহ স্বত্তাধিকারী হিসেবে যুক্ত হন মহিউদ্দিন শ্যামল। অনলাইনে একটি ফেসবুক পেইজই আমাদের ঠিকানা। 

শুরুটা করেছিলাম ব্লকের শাড়ি ও কাস্টমাইজ কূর্তি দিয়ে। ছবি আকঁতে পারতাম। সেই ছোটবেলা থেকেই আকাঁ আকিঁর প্রতি নেশা। পড়ায় ফাকিঁ দিয়ে ছবি আকঁতাম। সবসময়ই বকা খেতাম এজন্য। মায়ের নকশা করা জামা আর আমার একটু আকটু তুলির আচর এভাবেই কাটছিল দিন। বন্ধুদের জামাতেও একেঁ দিতাম, ইডেনের হলে বসে এক্রেলিকে তুলি ডুবিয়ে এই একটা সখের চর্চাই করা হত আমার। নিজের উদ্যোগে আকাঁ আকিঁ শুরু করি একসময়। প্রথম শাড়িটা ছিল কাশফুল আকাঁ, সেপ্টেম্বরের ৮ তারিখে প্রকাশিত হয় ফেসবুকের পাতায়। এরপর সব ভুলে শুধু আকাঁ আকিঁতেই মন দিই। 

তবে হ্যাঁ, এই যাত্রার আগেও ছোট্ট একটি উদ্যোগ ছিল আমার। ইডেনে পড়াশোনা করা কালীন বন্ধুরা মিলে প্রথম একটি উদ্যোগ নিই। ৪ জনের অর্থ বিনিয়োগ, আমার ডিজাইন আর সেই ডিজাইন পোশাকে সুইসুতোয় সবাই মিলে তুলে আনা এই ছিল প্লান। নানান কারণে সেই উদ্যোগ অসফল হয়। 

একাউন্টিং এ অনার্স মাস্টার্স করে ব্যাংকার না হয়ে ছবি আকাঁকেই পেশা হিসেবে বেছে নেওয়ার যাত্রাটা খুব সহজ ছিল না মোটেই। পরিবার থেকে সবাই চাইত আমি চাকরি করব, আমার নিজেরও শুরুতে তেমন ইচ্ছা ছিল। একটি অসফল উদ্যোগ, দুইটি চাকরির পর আমি সিদ্ধান্ত নিই এবার আর কোনোদিকে না তাকিয়ে নিজের মস্তিষ্কপ্রসূত কাজ নিয়ে শুরু করব আয়ের পথ খোজাঁ। আমার স্বভাব অনুযায়ী, কোনো পথে হেটেঁ ব্যর্থ না হওয়া পর্যন্ত আমি পথ বদলাই না, অন্যের কথায় তো কখনোই নিজের চিন্তা পরিবর্তন করি না। আবার নিজের শতভাগ এফোর্ড না দিয়ে সফলতা বা ব্যর্থতার হিসেব মেলাতেও বসি না। নিজের এই স্বভাব অনুযায়ীই চলছি, চলছে গুটিপোকা।

চ্যালেঞ্জ শুধু পরিবার, বা ব্যক্তি নিজে নয়। আমাদের সমাজ ভাবনাগুলোও একটা বড় চ্যালেঞ্জ। ক্রিয়েশনের মূল্যায়ণ আমাদের দেশে আছে আবার নেই। বাংলাদেশে ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি এখনো সেভাবে ডেভলপ করেনি। মানুষ অনেক বেশি পাশ্চাত্য ও ইন্ডিয়ান স্টাইল ফলো করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। নিজের নকশা বলতে টিভিতে দেখা নকশাকে একটু এদিক সেদিক করে করাকেই বোঝে। ফ্যাশনে আমাদের আবিষ্কার নেই, সবই আগে কারও করা। অর্থাৎ সবাই প্রভাবিত নকশা নিয়েই ডিজাইনার। সেক্ষেত্রে ক্রেতাও সেরকম, মূল্যায়নও সেরকম। দেশে যদি আরও বিবি রাসেল থাকতেন, আমাদের নিজস্ব ধারার চর্চা যদি আরও বাড়ত, তাহলে ক্রিয়েশনের মূল্যায়ণও বাড়ত। 

এরকম একটা বাজারে ইন্ডিয়ান পাকিস্তানি পণ্য নয়, আমার কাজ হ্যান্ড পেইন্ট নিয়ে। আমার ক্যানভাস হল পোশাক। প্রকৃতি থেকে প্রেরণা নিয়ে, যথাসম্ভব অপরের প্রভাব কাটিয়ে কাজ করি। ক্রিয়েশন ও কালেকশনের তফাত বোঝানোই কষ্ট হয়ে যায়। সম্মান অবশ্যই পাই। তবে শিল্প নিয়ে চর্চা বলে একটা অন্যরকম  ভালোবাসা পাই সবার কাছে। ঈর্ষা প্রতিদ্বন্দ্বিতা সবকিছুর ঊর্ধ্বে একটা ভালোবাসা, অন্য কোনো কিছু নিয়ে কাজ করলে এই ভালোবাসা পেতাম না। 

নিজেকে নারী হিসেবে আলাদা করে কখনো ভাবিনি। যা করতে চেয়েছি তা শুধু করে গেছি। আমার মা সবসময় আমার পথ চলার সংগী ছিলেন। এখন আমার পার্টনার, গুটিপোকার টিম সবাই আমার সঙ্গে আছেন, আমরা একসাথেই পথটা চলছি। আমি মূলত শাড়ি, পোশাক নকশা করা ও আকাঁর নির্দেশনা দেওয়ার অংশটা দেখছি, প্রতিষ্ঠানের অন্যান্য দিক দেখছেন আমার সহযোগী শ্যামল।

বাহ্যিক এসব চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি অনলাইন ব্যবসার নিজস্ব কিছু চ্যালেঞ্জ আছে। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো পণ্যের প্রেজেন্টেশন। গুটিপোকার যাত্রা যখন শুরু অনলাইন ব্যবসারও সেটা শুরুর দিক বলা যায়। তখন বড় বড় পেইজগুলো মডেল শ্যুট করত, তবে বেশিরভাগ পেইজই চলত ক্যাটালগ ছবি দিয়ে। ইন্টারনেটে পাবলিক ছবি মেয়েরা সাধারণত দিত না। প্রডাক্ট প্রেজেন্টেশনের প্রয়োজনে আমি নিজে মডেল হিসেবে সামনে আসি। একজন উদ্যোক্তার তার পেইজে মডেল হওয়া শোভন কিনা এই নিয়ে অনেক বিতর্ক এখন আছে, তবে এটা তখন এতটাই আনইউজুয়াল ছিল যে বিতর্কের অবকাশ ছিল না। একবাক্যে ‘না’ বলা হত এক্ষেত্রে। স্রোতের বিপরীতে দাড়িয়েঁ শুরু করি। আমার কাজকে আমার চেয়ে ভালোভাবে কে প্রেজেন্ট করবে, তাই না? হ্যাঁ, আমার মাঝেও দ্বিধা ছিল, প্রথমে মুখ ঢেকে ছবি দিতাম! পরে দেখলাম, আত্মবিশ্বাস নিয়ে ক্যামেররা সামনে দাড়াঁলে তথাকথিত সৌন্দর্য, অনিরাপত্তা এই সবকিছু নিয়ে সামাজিক ট্যাবুকে হারানো যায়। আমি সহ আমার বন্ধুরা এখন ছোট বোনেরা মডেল হিসেবে গুটিপোকার পোশাককে রিপ্রেজেন্ট করেন। তথাকথিত জিরো ফিগার ফর্সা মডেল আমাদের কখনোই ছিল না। অনেকে ইনবক্স করে ভালো মডেল নিতে বলতেন, মডেল নিয়ে বাজে কমেন্টও করতেন ছবির নিচে। এই সবকিছুকে পাশ কাটিয়ে আমি আমার লক্ষ্যে মন দিয়েছি। আমার কাজ ম্যানিকিনদের জন্য নয়, আমার বন্ধু, আমার আশেপাশের মানুষদের জন্য যারা তাদের ইম্পার্ফেকশন নিয়েই অনেক অনেক সুন্দর! পার্ফেকশানের স্বপ্ন দেখানোর আমি পক্ষপাতী নই।

গুটিপোকা অনেক বড় কোনো প্রতিষ্ঠান নয়, আমাদের কোটি টাকা মাসে আয় হয় না। তবে গুটিপোকা একটি স্বাবলম্বী প্রতিষ্ঠান, আমরা যারা এই প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত তারা এ প্রতিষ্ঠান থেকে আয় করি, নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেওয়ার সক্ষমতা ও সামর্থ্য অর্জন করি। এখানে গুটিপোকার সফলতা, এখানেই আমি সফল, আমরা সফল।