বগুড়ার সংসদ সদস্য রেজাউল করিম বেকার সমস্যা সমাধানে অভিনব উপায় বাতলেছেন। তিনি যা বলেছেন তার সারকথা হলো- মহামারীর সময়ে দেশ চার কোটির বেশী বেকার তৈরী হয়েছে, বেকারত্ব কমাতে চাকরিজীবী নারী ও পুরুষের মধ্যে আইন করে বিয়ে নিষেধ করা দরকার, যাতে করে বেকারত্ব কমে। এখানে উনার প্রস্তাবের অন্তর্নিহিত অর্থ হলো- উপার্জনকারী নারী বা পুরুষ বিয়ে করার সময় এমন নারী বা পুরুষকে বিয়ে করবেন যিনি উপার্জন করছেন না। এরকম বিয়ের পক্ষে উনার আরো একটি পয়েন্ট ছিলো স্বামী-স্ত্রী দুজনে চাকরী করলে সন্তানদের গৃহকর্মী দ্বারা নির্যাতনের সম্ভাবনা থাকে, ফলে উভয়ের চাকরী করার দরকার নেই। উনার এমন বক্তব্য প্রকাশিত হওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ নিয়ে বেশ আলোচনা চলছে। আমার বন্ধু-তালিকায় থাকা অনেকেই উনার বক্তব্যকে হাসি-তামাশার বিষয় বলে সাব্যস্ত করেছেন, এরকম বক্তব্যকে ব্যাক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ বলে অনেকেই অভিযোগ করেছেন। আবার এ লেখা যখন লিখতে বসছি তখন দেখলাম, দেশের বেসরকারী টেলিভিশন চ্যানেল যমুনা এবং ইন্ডিপেন্ডেন্ট উনার বক্তব্য তাদের ইউটিউব চ্যানেলে আপলোড করেছে। মজার বিষয় হলো এই দুই মিডিয়া হাউসের আপলোডকৃত ভিডিওর নিচে সিংহভাগ মন্তব্যগুলো এই বক্তব্যকে সমর্থন করেছে এবং প্রায় সব মন্তব্যকারীর লিঙ্গীয় পরিচয় হলো পুরুষ, বিরোধিতা যারা করেছেন তাদের প্রায় সবাই নারী। এই লেখায় আমি বিয়ে নিয়ে সাংসদ রেজাউল করিমের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে এমন সমর্থনমূলক এবং প্রত্যাখ্যানমূলক মনোভঙ্গির রাজনৈতিক-অর্থনীতি তুলে ধরার চেষ্টা করবো।

বিয়ে কি? সাধারন অর্থে বিয়ে হলো প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষের একসাথে বসবাসের ধর্মীয় ও সামাজিক চুক্তি বা অনুমোদন। বিয়ে ধর্ম ও সমাজ স্বীকৃত পন্থায় নারী-পুরুষের যৌন সম্পর্ক স্থাপন এবং সন্তান উৎপাদনকে বৈধতা দেয়। অন্যথায় বিয়ে ব্যাতিরেকে যৌন সম্পর্ক স্থাপন ও সন্তান উৎপাদনকে সমাজ ও রাষ্ট্র স্বীকৃতি দেয় না। এবার আসা যাক, বিয়ে কিভাবে সংঘটিত হয়? আমাদের দেশে বিয়ে এখনো মোটাদাগে নারী ও পুরুষের দুই পরিবারের সম্মতির সাপেক্ষে হয়। নারী ও পুরুষের স্বাধীন ইচ্ছা এখনো ততটা গুরুত্ব পায় না। পরিচিত অনেক বন্ধু-বান্ধবী এবং মানুষ আছেন যারা পরিবারের অপছন্দের কারনে নিজেদের পছন্দের মানুষকে বিয়ে করতে পারেননি। এটা বলছি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্তদের ক্ষেত্রে। কিন্তু কম শিক্ষিত এবং নিম্নবিত্ত পরিবারের ক্ষেত্রে বিয়ের সিদ্ধান্ত প্রায় বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই পরিবারের সিদ্ধান্তে হয়। এই সিদ্ধান্ত কোন প্রক্রিয়ায় এবং কোন কোন ফ্যাক্টর বিবেচনা করে গ্রহণ করা হয়? মোটাদাগে বলতে গেলে, কনের ক্ষেত্রে তাদের হবু বর ও বরের পরিবার দেখে মেয়ে দেখতে কেমন? ফর্সা না কালো? রান্না করতে পারে কিনা, স্বভাব-চরিত্র কেমন, শিক্ষাগত যোগ্যতা কতটুকু ইত্যাদি। অন্যদিকে কনে ও তার পরিবার হবু বর নির্বাচনে যে বিষয়টাকে প্রাধান্য দেন তাহলো ছেলে কি করে? কত টাকা আয় করে? সরকারী চাকুরী করে না বেসরকারী চাকুরী করে? ছেলে যদি সরকারী চাকুরী করে বা মোটা অংকের টাকা উপার্জন করে তবে ছেলে দেখতে কেমন বা তার স্বভাব-চরিত্র কেমন সে বিষয় খুব একটা গুরুত্ব পায় না। বলে রাখা ভালো এ চিত্রের ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে, তবে আমি সামগ্রিক সমাজ বাস্তবতাকে এখানে তুলে ধরেছি।

এখানে লক্ষনীয় বিষয় হলো- পুরুষকে ধরাই হয় রোজগারকারী। রোজগারহীন পুরুষ সমাজে অবহেলিত, অপমানিত, এবং হাসি-তামাশার বিষয়। পুরুষের উপার্জন ক্ষমতা তাকে সমাজে পুরুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় পুরুষের পৌরুষত্ব নির্ভর করে সে কত বেশী রোজগার করতে পারে, কতটা ভালোভাবে তার পরিবারের ভরণ-পোষণ ও অন্যান্য প্রয়োজন মেটাতে পারে। এটি পুরুষের জন্য ক্ষতিকর। রোজগারের চাপ তাকে আরো বেশী আক্রমনাত্মক অথবা হতাশাগ্রস্থ করে তোলে। অনেকেই মানসিক চাপে পিষ্ট হয়ে আত্মহত্যার পথ পর্যন্ত বেছে নেন। উদাহরণ হিসেবে সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়া পুলিশের আত্মহত্যার কথা বলা যায়। দেখা যাচ্ছে, এ আত্মহত্যার অন্যতম কারণ অর্থনৈতিক। অপরদিকে নারীর এই চাপ নিতে হয়না। এমনকি শিক্ষিত ও উপার্জনক্ষম এবং উপার্জনকারী নারীও চায় না তার সঙ্গী বা স্বামী বেকার থাকবে কিংবা উপার্জন করবে না। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে লিঙ্গীয় ইস্যু কোর্স পড়াতে গিয়ে প্রসঙ্গক্রমে আমার ছাত্রীদের জিজ্ঞেস করেছিলাম তারা কেমন মানুষকে জীবনসঙ্গী হিসেবে চায়? বেশীরভাগ-ই বলেছিলো তারা এমন পুরুষকে বিয়ে করবে যে অবশ্যই শিক্ষিত হবে এবং অবশ্যই উপার্জন করবে। কেউই এটা মানতে পারেনি যে তাদের ভবিষ্যৎ স্বামী কখনোই উপার্জন করবে না। এমনকি তারা নিজেরা যদি পরিবারের ভরণ-পোষণ ভালোভাবে চালানোর মত সক্ষমতাও অর্জন করে তবুও তাদের পুরুষ সঙ্গীকে অবশ্যই উপার্জন করতে হবে এবং তাদের চাইতে বেশী উপার্জন করতে হবে এমনটাও অনেকে বলেছেন। এই মনোভঙ্গি অবশ্যই সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক। কিন্তু এই মনোভঙ্গি কিন্তু সমাজে লিঙ্গীয় সম্পর্ককে সংজ্ঞায়িত করে দেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূ্র্ণ। সংক্ষেপে বললে, যেহেতু পুরুষ একরকম উপার্জন করতে বাধ্য এবং সংসারের বা পরিবারের ব্যয়ভার বহন করতেও বাধ্য, ফলে তার অর্থনৈতিক সক্ষমতার জোরে সে নারীকে অধঃস্তন হিসেবে দেখে।

সাংসদ রেজাউলের বক্তব্য এই ডিসকোর্সকে প্রশ্ন করে। তিনি বলেছেন চাকুরিজীবি বা উপার্জন করছেন এমন দুজন নারী-পুরুষ বিয়ে করতে পারবেন না। এখন, আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে পুরুষরাতো তা সব সময়ই করে আসছে, তারা উপার্জনহীন নারীকে বিয়ে করছে। কিন্তু নারীদের ক্ষেত্রে বিষয়টা একদমই ব্যতিক্রম। ফলে উনার বক্তব্য আসলে যেটা নির্দেশ করে তাহলো উপার্জনহীন পুরুষকে উপার্জনকারী নারী বিয়ে করুক। তাদের দায়িত্ব নিক। পলিসি হিসেবে এটার সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে আলোচনা হতে পারে, কিন্তু এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, তার এই বক্তব্য সমাজের লিঙ্গীয় সম্পর্কের একটি মহাগুরুত্বপূর্ন দিক আমাদের সামনে নিয়ে এসেছে। তিনি প্রচলিত লিঙ্গীয় সম্পর্কের ভূমিকার পিতৃতান্ত্রিক ডিসকোর্সকে প্রশ্ন করেছেন, ধাক্কা দিয়েছেন। উপার্জনকারী পুরুষ উপার্জনহীন নারীকে সাময়িক সময়ের জন্য বা সারা জীবনের জন্য বিয়ে করতে পারলে উপার্জনহীন পুরুষকে সাময়িক সময় বা সারা জীবনের জন্য উপার্জনকারী নারীকে কেন বিয়ে করতে পারবেন না? তার বক্তব্যর মধ্যে অন্তর্নিহিত এই প্রশ্ন আমাদের শিক্ষিত ও প্রগতিশীল নারী-পুরুষদের অনেকেই মেনে নিতে পারেননি। এমনকি উনার বক্তব্যের সময় সরকারী ও বিরোধী সাংসদরাও হাসাহাসি করছিলেন। এর অন্যতম কারন আমাদের মননে ঘাপটি মেরে থাকা পিতৃতন্ত্রের মতাদর্শ। এমনকি যারা এর বিরোধকারী তারাও ক্ষেত্রবিশেষে এই মতাদর্শ থেকে বের হতে খাবি খান। কিন্তু সমাজে নারী-পুরুষ সমতা সাধন ততক্ষন খুব দূরের বস্তু হবে যতক্ষন না এ ধরনের শক্তিশালী মতাদর্শিক অবস্থান থেকে আমরা সরে না আসতে পারবো। জীবিকার চাপ পুরুষের উপর এ ধরনেরই শক্তিশালী মতাদর্শিক চাপ, যা তার মনন ও মানসিকতাকে প্রভাবিত করে। ফলে, একে অপরাপর লিঙ্গীয় ইস্যু সমূহের মতই প্রশ্ন করা উচিৎ, বিনির্মান করা উচিৎ। এটা সমাজ, রাষ্ট্র, পরিবার, এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করা প্রয়োজন। আর এই পয়েন্টেই সাংসদ রেজাউলের বক্তব্যকে আমি হাসি-তামাশার বিষয় বলে মনে করি না। এই হাসি-তামাশা করাকেই আমি লিঙ্গীয় রাজনীতির অপর পিঠ বলতে চাই, যেখানে লিঙ্গ কেন্দ্রীক আলোচনা ও প্রশ্ন শুধুমাত্র একপক্ষের ওকালতি করে, এবং অপর পক্ষকে এড়িয়ে যায়। কিন্তু সমতার আলোচনা একপক্ষ বাদ দিয়ে কতটুকু সম্ভব তা ইতিমধ্যেই বেশ আলোচিত বিষয়।

পরিশেষে, সাংসদের বক্তব্যের অন্যান্য উপাদান বিষয়ে আমার অবস্থান স্পষ্ট করতে চাই। আমি উনার মত করে আইন করার পক্ষপাতী নই, কারন আধুনিক সময়ে চর্চা যাইহোক বিয়ে বা সঙ্গী পছন্দের স্বাধীনতা সবার আছে (যদিও আমাদের পছন্দ কতটুকু আমাদের আর কতটুকু সমাজ, সংস্কৃতি, ও রাষ্ট্রের গড়ে দেওয়া তা নিয়ে বিস্তর বিতর্কের অবকাশ আছে)। কিন্তু এটাও ভুলে গেলে চলবে না, রাষ্ট্র চাইলে যে আপনার আমার একান্ত ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তেও হস্তক্ষেপ করতে পারে তার বহু নজির আছে (এখানে ভালো কি মন্দ সে বিচার করছি না)। যেমন- চীনের এক সন্তান নীতি। যদিও চীন এই নীতি থেকে সম্প্রতি সরে এসেছে কিন্তু বেশ কয়েক বছর চীন একের অধিক সন্তান নেওয়া আইন করে বন্ধ রেখেছিল। যাহোক, সাংসদের বক্তব্যের আরো একটি বিষয় আছে যা সমস্যাজনক, তাহলো- সন্তান গৃহভৃত্য কর্তৃক নির্যাতিত হচ্ছে  এ কারণে নারী বা পুরুষ কারো একজনকে চাকুরী না করার পরামর্শ। উনি এখানে বলতে ব্যর্থ হয়েছেন যে বেকারদের কর্মসংস্থান করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। উনি বলতে পারেননি, কর্মজীবি বাবা-মায়ের সন্তানদের লালন-পালনে রাষ্ট্রের ও প্রতিষ্ঠানসমূহের দায়িত্ব নেওয়া প্রয়োজন, উচিৎ মানসম্পন্ন ডে-কেয়ার ব্যবস্থা চালু করা, প্রয়োজনে আইন করে। উনার বক্তব্যর বড় সমস্যাজনক দিকটাই হলো বেকার সমস্যা সমাধানে রাষ্ট্রকে দায়মুক্ত রাখা এবং এই সমস্যা সমাধানে ব্যক্তির সঙ্গী নির্বাচনের স্বাধীনতায় রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ কামনা করা, যা কতৃত্ববাদী এবং স্বৈরাচারী রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য হতে পারে, গণতান্ত্রিক ও কল্যানমুখী রাষ্ট্রের নয়।

মোঃ মিজানুর রহমান, সহকারী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা-১১০০।