আচ্ছা, এই কথাটা বললে কি আপনারা অনেক কষ্ট পাবেন? পাইয়েন না প্লিজ। হইছে কী, সবাই বলে না যে বাচ্চা হওয়ার যন্ত্রণা এক নিমিশেই ভুলে যাওয়া যায় ওকে কোলে নিলে? ওর মুখ দেখলে? আমার বেলায় তা হয় নাই। আমি ভয়ে ছিলাম। যখন আমাকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে গেল তখনই শুরু। আমি তার চেহারা দেখি নাই, কিন্তু পিছন থেকে এসে ভারী গলায় বলল, উনি আমাকে এনেস্থিসিয়া দিবে। একদম নড়া যাবে না, নড়লে আবার নতুন করে দিবে। আমি ভয়ে শক্ত হয়ে গেলাম। উনি স্পাইনাল কর্ডে খট করে শক্ত কিছু একটা পুশ করে চলে গেলেন। চলে যাওয়া অব্দি শক্ত ছিলাম, একদম কাঠ। চলে যেতেই কাঁপা শুরু হল। প্রথমে হাত। এরমধ্যেই শোয়ানো, তলপেট কাটা, ইন্টার্নিশিপ এর ছাত্রছাত্রীদের কিসব বুঝাচ্ছেন ডাক্তার। বাচ্চার পজিশন, এই সেই। দূর থেকে আসছিল কথা গুলো। বর্ষাও ছিল তাদের একজন। শক্ত করে আমার হাত ধরে ছিল মেয়েটা। ততক্ষণে আমার কাপাঁকাপি হাত ছাড়িয়ে সারা শরীর। আমার মেয়েকে আমার সামনে আনা হল। আমার দুঃখ, আনন্দ কিছুই হল না। কি এক ঘোরের মধ্যে খালি মনে হল, ‘আমি ঘুমাইতে চাই, এই বাচ্চা এইখানে কি করে?’
আমি সত্যি সত্যি ঘুমায়েই গেলাম। যখন টের পেলাম, তখন লিফটে আমি, বিছানাসহ। আমাকে কোথা থেকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে যেন। তখনও শরীর কাঁপছে। আমি চাইছিলাম আবার অজ্ঞান হয়ে যেতে। ভাল্লাগছিল না আশেপাশের কিচ্ছু। আবার সব অন্ধকার। এরপর জ্ঞান ফিরলো আইসিইউ তে। বাচ্চাকে শালদুধ খাওয়ানোর চেষ্টা চলছে। আম্মু অবাক হয়ে নার্সকে বলছে, “এখনো শরীর কাঁপছে কেন? বিছানা টিছানা সহ!” আর আমার খালি শীত লাগছিল। কী ভীষণ এক শীত। বার বার মনে হচ্ছিল, বাচ্চাটার দুধ খাওয়া শেষ হবে কবে? কেমন একটা ভোঁতা ভয় আমাকে ঘিরে ছিল।
দুই দিনের দিন, একজন ডাক্তার আসলো এক গাদা ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে, মিনিট দশেকের জন্য। বাচ্চা ছিল আমার ননদের কোলে। কোন রকমের ভূমিকা ছাড়াই আমাকে বললেন, “বাচ্চা কোলে রাখেন না কেন? এই এক স্টাইল হইছে মায়েদের! মায়ের ওম পেলেই তো বাচ্চার কোন ঠান্ডা টান্ডা লাগে না।” প্রথম মিনিটেই আমার মাতৃত্বের ফাঁকিবাজি বুঝে ফেলা জ্ঞানী ডাক্তারের দিকে অবাক হয়ে তাকানোর অবস্থাও ছিল না আমার তখন। কোন রকমে কোলে নিলাম মেয়েকে। ভাল মা হওয়ার রেসে নাম লিখাইলাম আমি। এইবার, ‘মাতৃত্ব মহৎ’ এই বিষয়টা শয়নে স্বপনে চিন্তায় বুদ্ধিতে ঢুকায়ে ফেলতে পারলেই, মোটিভেশন সহ রেসে দৌড়ানো যাবে আর কি!
কিন্তু তা আর পারলাম কই? প্রথম মাসে ওর সাথে কথা বলতাম -এমন কিছুই মনে পড়ে না আমার। তাকায়ে থাকতাম হয়ত, কিন্তু চুপচাপ। আমার ক্ষুদা পেত খুব। খেতে বসলেই বাচ্চার পেশাব বা পায়খানা হত। অথবা ক্ষুদা লাগত। আর আমি খেতে না পাইলে মেজাজ করতাম। আমার আশেপাশের সবাই অবাক হয়ে দেখত, এমন স্বার্থপর মা কে। নিজের খাওয়া যার কাছে প্রায়রিটি। এরমধ্যেই আমার মা ঘোষণা দিলেন, বাচ্চার হাগু আর মুতু অন্য কাওকে দিয়ে ধোয়ানো যাবে না। এটা কেবল মাকেই করতে হয় নাকি। আমিই করতাম যদিও। কিন্তু বিশ্বাস করেন, ‘মহৎ মাতৃত্বের’ টনিক গেলা সত্ত্বেও ওর হাগু কে হাগুর মতই ঘেন্না লাগত আমার।
আমি ওর সাথে কথা বলা শুরু করি আরও পরে। তখন ওর দুই বা আড়াই মাস। বুকের দুধ খেতে খেতে হুট করেই খাওয়া বাদ দিয়ে আমার দিকে তাকালো সে, ফিক করে হেসে দিল। আমিও হাসলাম। আমার মনে আছে তারপর থেকেই আমরা দুইজনে গুটুর গুটুক করে গল্প করতাম। ওর চার মাস বয়সে যখন অফিস শুরু করলাম আবার, আমার কলিগরা ভীষণ মায়া দেখাতে লাগল। আমি কিছুতেই মুখ ফুটে বলতে পারলাম না, “ইটস ওকে, আমি যে ওকে ২৪ ঘন্টা দেখছি না, তাতে সমস্যা নাই। ওর প্রতি আমার মায়া কমছে না তাতে। টেনশন নিয়েন না প্লিজ।” আরও সাহসী হইলে হয়ত বলা যেত, “চব্বিশ ঘন্টা গায়ের সাথে গা লাগায়ে রাখা কোন কাজের কথা না। নিজে নিঃশ্বাস নেন; বাচ্চাটাকেও নিঃশ্বাস নিতে দেন।“ কিছুই বলি না আমি। মুখ করুণ করে যতখানি দুঃখে থাকি তারচে বেশি ভাব দেখাই। কিচ্ছু করার নাই, একজন “মহৎ মায়ের” প্রতি এটা আমাদের সুইট কিউট সমাজের দাবী। মাথায় গেঁথে যাওয়া ছোটবেলার সেই ভাবসম্প্রসারণ “বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে”। একদিন অফিস থেকে বের হতে যাব, কি একটা ছোট কাজে আটকে গেলাম। কাজ শেষে বস বললেন, তাড়াতাড়ি বাসায় যান, একটু রেস্ট করেন। আমি আমার নত স্বরে বললাম, ‘আমার অফিসেই ভাল রেস্ট হয়।’ বস হেসে দিলেন। সত্যটা তারও জানা ছিল নিশ্চয়ই। কিন্তু এটা এমন এক সত্য যেটা বলার নিয়ম নাই।
ওর দেড় বছর বয়সে আমার এক সহকর্মী মাতৃত্ব সম্পর্কে বলতে গিয়ে বেশ উত্তেজিত হয়ে বলে ফেললেন, যেসব মায়েদের সিজারিয়ানে বাচ্চা হয়, তাদেরকে তিনি মা হিসাবেই গণ্য করেন না। আমি উনার দিকে তাকিয়ে ছিলাম ম্যালাক্ষণ। কি অবাক বিষয়, তাই না? জৈবিক কারণে বাচ্চা জন্মদানের যার কোনই ক্ষমতাই নাই বা পুরো প্রক্রিয়ার অভিজ্ঞতাই যার নাই, তিনি কিনা কি ভীষণ দাম্ভিকতায় খারিজ করছেন আমার মাতৃত্বকে। আমি অবাক হয়ে উনার এই আস্পর্ধা দেখি। আমার মাতৃত্ব নিয়ে এখন অব্দি যারা ভালবেসে উদবিগ্ন হয়েছেন, তাদের অধিকাংশই বাচ্চা জন্মদান বা পালনের মত বিষয়কে দূর থেকে ক্রিটিক্যালি পর্যবেক্ষণ করা মানুষ। এই মানুষগুলাকে আমার দেখতে ভাল্লাগে। এরা নিজেরাও জানে না, কি ভীষণ বিনোদনের উৎস উনারা।
এমন একজন আত্মীয়ার কথা বলি। এক জন্মদিনে গেছি। মেয়ের বয়স তখন তিন কিম্বা চার। তিনি ওকে কি একটা খেতে দিয়েছেন। ও খেয়ে নিয়েছে। উপরন্তু, মেয়ে আরও খেতে চাইছে। এত বড় (অ)স্বাভাবিক ঘটনা আমার সেই আত্মীয়া হয়ত দেখেননি কোনকালে। সেই অনুষ্ঠানে আমিসহ যাকে যাকে সামনে পাচ্ছিলেন তাকেই বলছিলেন, “মেয়েটা চাইয়া চাইয়া খাইতাছে, আহারে! মা সারাদিন বাইরে বাইরে থাকে তো! কি মায়াই যে লাগে।” আমি বার কয়েক বলার চেষ্টা করলাম, ‘খিদা লাগলে খাবার তো চাওয়াই উচিৎ।‘ আমার কথা হালে পানি পেল না একেবারেই। উনার বিস্মিত হবার তোড়ে এবং সেটা সবার মধ্যে ছড়ায়ে দেয়ার তাড়াহুড়ায়, আমি নিজেও দ্বিধায় পড়ে যাই।
এই যে মা হিসাবে আমি চিরদুঃখী, অশ্রুছলছল চোখে থাকলাম না, বাচ্চার খাওয়া নিয়ে অকারণে উদগ্রীব হলাম না – এটা কি আসলে অস্বাভাবিকতার পর্যায়ে পড়ে? বা বাচ্চার চেহারা দেখে যে আমি অপারেশনের ব্যথা ভুলতে পারলাম না বা বাচ্চাকে বাসায় রেখে অফিস করতে আমার অতটা খারাপ লাগত না – এটা স্বীকার করা কি আমার মাতৃত্বকে ছোট করে দিবে? জানি না আসলে। তবে আমি কখনই চাই না, আমার ‘মাতৃত্ব’, আমার ‘আমি’ থেকে বড় হোক।
এতো ভালোলাগলো! হাসলাম অনেক্ষন।
বাচ্চার চেহারা দেখে আপনার মত আমার কুইন অব দি হাউজ অপারেশনের ব্যথা ভুলতে পারে নাই। সত্যটা হল আপনার বোধটাই কেবল সত্য। কেউই ভুলতে পারে না অপারেশনের ও অপারেশন পরবর্তী যন্ত্রনাটাকে। পাথর্ক্য কেবল আপনি বলতে পেরেছেন, অন্যরা অভিনয় করে সত্যটা স্বীকার করে না, এই যা। আর পূর্ণজন্ম বলে যদি কিছু থাকে তবে আমি পুরুষ হয়েই জন্মাতে চাই আবার এবং বারবার। মহিলাদের অনেক দায়িত্ব। সবার আগে উঠতে দেখি, ঘুমাতেও।
অতি ভালো লেখা। এসব পড়লে মাতৃত্ব-র গা থেকে বাড়তি চর্বিগুলো ঝরে পরে। মাতৃত্ব বুঝতে সবিধা হয়।