মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদান একদিকে যেমন সীমিতভাবে উপস্থাপিত হয়, অন্যদিকে ধর্ষণের ভয়াবহতা ‘ইজ্জত’ শব্দের মধ্য দিয়ে লঘু করা হয়েছে। শুধু এই একটি শব্দ দিয়ে অপরাধের শিকার নারীর শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক ক্ষতির মাত্রা বোঝা যায় না। ফলে দীর্ঘ সময়ে এই নারীরা সামাজিকভাবে ‘ইজ্জত’ হারা হয়ে আরও সামাজিক হেনস্তার ভয়ে তাঁদের ওপর করা অন্য নির্যাতনের কথা সামনে তুলে ধরতে পারেননি। কারণ, রাষ্ট্রীয় এই শক্তিশালী প্রতিষ্ঠিত বয়ান পরবর্তী সময়ে নানাভাবে ধর্ষণের শিকার নারীদের বিড়ম্বনাই তৈরি করেছে এবং ‘বীরাঙ্গনা’ মর্যাদা প্রতিষ্ঠার বিপরীতে কাজ করেছে।


এই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণার সিদ্ধান্ত একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার (মুজিবনগর সরকার) নিলেও, পরবর্তী সময়ে যুদ্ধে ধর্ষণের শিকার নারীদের জন্য নানা ধরনের কর্মসূচি গ্রহণ করা হলেও, অনেক নারীকে বাঁচানো যায়নি আত্মহত্যা থেকে। এর পেছনের কারণ ধর্ষণকে অপরাধ হিসেবে না দেখে সামাজিকভাবে ‘ইজ্জতহানি’ হিসেবে দেখা। এই বিষয়ে আমাদের মনে রাখতে হবে, ধর্ষণের মতো অপরাধকে ইজ্জতহানি/শ্লীলতাহানির ঘেরাটোপে আটকে রাখার ফলে বিষয়টা যেন সহনীয়ভাবে হাজির করা হয়। এর মাধ্যমে মানুষের মনে এটির আইনগত ভিত্তির চেয়ে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিকে সামনে হাজির করা হয়।

ছবিসূত্র: ইন্টারনেট


আমাদের যে দুই লাখ নারী (যদিও গবেষক সুজান মিলারের হিসাবে আরও অনেক বেশি) ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, পৃথিবীর অন্যতম জঘন্য হিংস্রতার শিকার হয়েছেন, তাঁদের সেই নিপীড়নের ইতিহাস অগ্রন্থিত রয়ে গেছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সেই নিপীড়নের খুব কম সাক্ষ্যই নিতে পেরেছে। তার কারণ, দীর্ঘ সময় এই বিষয়ে আমাদের নীরবতা, লোকলজ্জা এবং ধর্ষণকে অপরাধ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার ক্ষেত্রে একধরনের পুরুষতান্ত্রিক দোনোমনা ভাব। ফলে স্বাধীন দেশেও ধর্ষণের শিকার নারী ‘লোকলজ্জা’ বা সামাজিক সম্মানের ভয়ে সেটি গোপন রাখছেন। সামাজিক ধারণা হলো, নারীর শরীর ‘নষ্ট’ হয় এবং দূষিত হয়। সেই নারীর শরীর ঘেঁষে ওঠানামা করে পরিবার বা সমাজের ‘ইজ্জত’ বা ‘সম্মান’!!


‘ইতিহাসজুড়ে, সারা পৃথিবীতে, আমাদের সামষ্টিক চেতনায় যোদ্ধার ভূমিকা পুরুষের জন্যই তুলে রাখা। যুদ্ধ ও সহিংসতার প্রেক্ষাপটে নারীকে নেতা কিংবা সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীর ভূমিকায় দেখার রেওয়াজ নেই’ (গায়েন, ২০১৩)। আমরা রাজনৈতিক স্বাধীনতা পেয়েছি তা আজ পঞ্চাশ বছর। যে জাতীয়তাবোধে দেশ স্বাধীন হলো, তা আজও বিতর্কিত। এ প্রশ্নে দেশ দ্বিধাবিভক্ত। কেউ বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী, কেউ আবার বিশ্বাসী বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে। বিশ্বাসের ভিত্তি কি যুক্তি না আবেগ? মানব সভ্যতার শিখরে দাঁড়িয়ে, এ প্রশ্নের জবাবে যুক্তি ও প্রাসঙ্গিকতা প্রাধান্য পাবে, তা নিশ্চয়ই প্রত্যাশিত! কেউ বাঙালি, আবার কেউ বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের দাবিদার। আসলে আমি, আপনি, আমরা জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে কী? বাঙালি না বাংলাদেশী? এ দুয়ের মাঝে কী কোনও দ্বন্দ্ব আছে? একটি জনগোষ্ঠীর মাঝে জাতীয়তার জন্ম ও তার প্রসার কিভাবে ঘটে তা উপলব্ধির বিশেষ প্রয়োজন। আদর্শ হিসেবে জাতীয়তাবাদ মানুষের আত্মপরিচয়গত সংগ্রামের অন্যতম একটি রূপ হতে পারে, কিন্তু তাকেই একমাত্র আদর্শ হিসেবে ভাবা সঠিক নয়। মানুষের আত্মপরিচয় জাতি-পরিচয়কে ঘিরে গড়ে উঠতে পারে, কখনো শ্রেণী-পরিচয়ও দখল করে নেয় ওই আত্মপরিচয়ের স্থান। আবার কখনও সংস্কৃতি, ধর্ম বা ভাষা-পরিচয়। তবে জাতীয়তাবাদী চেতনা হলো অতিমাত্রায় খেয়ালি এক আদর্শ। তার উদাহরণ হয়তো বা ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারির শাহবাগ চত্বর। নতুন প্রজন্মের হাতে সেখানে নতুন আদলে সে আত্মপ্রকাশ পেয়েছিল যখন, তার আগে সবাই ভেবেছিল জাতীয়তাবাদের ইতিমধ্যে সমাপ্তি ঘটে গেছে। ফলে জাতি-পরিচয়ের শক্তিকে কখনো একেবারে খাটো করে দেখা যায় না, আবার তাকে খুব শক্তিশালী ভেবে নিশ্চিন্ত হওয়াও কঠিন। সবকিছু আসলে নির্ভর করে কোন শক্তি তার পেছনে দাঁড়িয়ে, কার কণ্ঠ থেকে উচ্চারিত হচ্ছে জাতীয়তাবাদী স্লোগান, তার ওপর। ফলে দোষ-গুণটা আসলে জাতীয়তাবাদের নয়, বরং জাতি-পরিচয়ের অনুভূতিকে সমাজের কোন শক্তি কীভাবে ব্যবহার করছে তার ওপর।


তাই, মুক্তিযুদ্ধের যে বয়ান আমাদের দেশে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে প্রধান বয়ান হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে, তা কেবল জাতীয়তাবাদীই নয় ; সেই বয়ান পুরুষতান্ত্রিক বয়ানও বটে। অর্থাৎ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আক্ষরিক অর্থেই ‘His-Story’; ‘Her-story’ হয়ে উঠতে পারেনি! আমাদের সমাজ বাস্তবতায় মুক্তিযোদ্ধা সনদ আর বীরাঙ্গনা সনদের মূল্য কি এক? বীরত্ব অর্জনের ইতিহাস কি একই সমতলে দাঁড়িয়ে আছে? আদৌ বীরাঙ্গনা সনদ বলতে কি কিছু আছে? বীরাঙ্গনা সন্তান কিংবা পরিবারের কোনো কোটা? রাষ্ট্রীয় সুবিধা কি আছে? বীরাঙ্গনা মায়ের সন্তান মাত্রই কি যুদ্ধশিশু? বীরাঙ্গনা মায়ের সন্তান কি আমাদের সমাজে সম্মানিত? আমার মাথায় প্রশ্ন আসে, বীরাঙ্গনা সনদ দেখিয়ে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষীয়তার প্রমাণ দেওয়া কি আমাদের সমাজে সম্ভব?


১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে সদ্য স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশ রাষ্ট্র মুক্তিযুদ্ধকালে ধর্ষিত ২ লক্ষ নারীর স্বাধীনতা যুদ্ধের বীর হিসেবে ‘বীরাঙ্গনা’ (যুদ্ধের সাহসী নারী/যুদ্ধের হিরোইন) নামে ভূষিত করেন (ব্রাউনমিলার ১৯৭৫; মুখার্জী ২০০২)। ১৯৭১-এর ডিসেম্বরের শেষ দিক থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন সংবাদপত্রে মুক্তিযুদ্ধকালীন নারী ধর্ষণের বিষয়টি খবরে আসতে থাকে এবং প্রকাশিত সংবাদগুলো আরও উল্লেখ করতে থাকে যে, ‘প্রথাগত বাঙ্গালী গ্রামীণ সমাজে নারীদের পর্দার মধ্যে থাকতে হয় এবং ধর্ষণের শিকার নারী সমাজ থেকে বিতাড়িত হয়ে থাকেন’। মধ্য জানুয়ারিতে জেনেভায় ওয়ার্ল্ড কাউন্সিল অফ চার্চের এশিয়া শাখার ত্রাণ সচিব তাঁর প্রেস কনফারেন্সে বলেন, ‘ঢাকায় অবস্থিত বাংলাদেশের সরকারের হিসেব অনুযায়ী ৯ মাসের এই যুদ্ধে ২ লক্ষের বেশি নারী পাকিস্তানি হানাদারবাহিনীর হাতে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। হাজার হাজার নারী গর্ভবতী হয়ে পড়েছেন। সমাজের নিয়ম অনুযায়ী, কোনো মুসলিম স্বামীই অন্য পুরুষ শরীর ছুঁয়েছে, এমনকি জোরপূর্বক ধর্ষণের শিকার হয়েছে এমন স্ত্রীকেও নিজ ঘরে ফিরিয়ে নেন না। নতুন সরকার এই প্রথা ভাঙ্গবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। সরকার নারীদের জাতির বীর হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন এবং তাদের ভিকটিম হিসেবে চিহ্নিত করছেন। সরকারের এই পদক্ষেপের পরেও অতি অল্প সংখ্যক স্বামী তাদের স্ত্রীদের বাড়িতে ফেরত নিচ্ছেন’ (ব্রাউনমিলার ১৯৭৫)।


মুক্তিযুদ্ধের সময়কার ধর্ষণের বিষয়টি আধুনিক যুদ্ধের ইতিহাসে স্বতন্ত্র নয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালে জার্মান সৈনিকের হাতে বেলজিয়াম ও ফ্রান্সের নারী ধর্ষণের মাত্রা কিংবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে সোভিয়েত রাশিয়ার গ্রামীণ নারীদের ধর্ষণের মাত্রার সাথে ৭১-এর বাঙালি নারীর ধর্ষণের মাত্রাগত কোনো অমিল নেই। মিল থাকলেও অপরাপর প্রেক্ষিত থেকে, ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ২ লক্ষ নারীর ধর্ষণের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণভাবে স্বতন্ত্র। কারণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে মুক্তিযুদ্ধকালে সশস্ত্র পাক হানাদারবাহিনীর নিরস্ত্র নারীর ওপর ধর্ষণের বিষয়টিই প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক পরিসরে সমগ্র বিশ্বজুড়ে একটি রাজনৈতিক সহিংসতা হিসেবে চিহ্নিত হয়।
নারীর প্রতি যত ধরনের সহিংসতা দেখা যায়, তার মধ্যে ধর্ষণই হচ্ছে সবচাইতে প্রচলিত ও সামাজিকভাবে অপমানজনক। প্রথাগত মতাদর্শে মনে করা হয়, ধর্ষণ আঘাত হানে ‘সম্মান’ বা ‘ইজ্জতের’ ওপর। এই পুরুষালি মতাদর্শেই কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময়কার বীরাঙ্গনা নারীদের কথা বলতে গিয়ে বলা হয়, ‘২ লক্ষ মা বোনের ইজ্জত হরণ’। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে এই ইজ্জত কার ইজ্জত? গুরুত্বপূর্ণ হলো, এই ইজ্জত বা সম্মান নারীটির পরিবার ও সমাজের ইজ্জত, যে ইজ্জতের মালিক সমাজের অভিভাবক, নারীর অভিভাবক। সোজাকথায়, পুরুষালি ভাবনার এই সমাজে নারীর অভিভাবক পুরুষ। যুদ্ধাপরাধের দলিলসমূহে ধর্ষণ ও নির্যাতনকে পৃথকভাবে দেখা হয়েছে এবং প্রথম দিককার দলিলসমূহে ধর্ষণকে নির্যাতনের চাইতে তুলনামুলক কম গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে (গুহঠাকুরতা, ১৯৯৭)।


প্রচলিত মতানুযায়ী মনে করা হতো, যুদ্ধের সময় প্রতিপক্ষের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহের জন্য নির্যাতন করা হয়। আধুনিক বিশ্বের স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, বন্দিকে ক্ষমতাচ্যুত করা এবং সমাজের ভেতরকার প্রতিরোধ ভেঙে ফেলবার জন্য নির্যাতন করা হয়। নারীর কাছ থেকে কেবল তথ্য সংগ্রহ নয় বরং সশস্ত্র সংগ্রামে পুরুষরা যখন সক্রিয়ভাবে যুদ্ধে অংশ নেন, সে সময় নারী ও শিশু ঘওে থাকে, সংসারের হাল ধরে রাখে নারী, দৈনন্দিন কাজে সক্রিয় থেকে সমাজকে টিকিয়ে রাখে নারী। নারী তখন হয়ে ওঠে সিভিল সমাজের কর্ণধার (ব্রাউনমিলার ১৯৮৬; গুহঠাকুরতা ১৯৯৭)। সিভিল সমাজের প্রতিনিধি হয়ে ওঠা নারীদের তখন ধর্ষণ ও ধর্ষণের ভীতিপ্রদর্শনের মাধ্যমে গৃহছাড়া হতে বাধ্য করা হয়। নারীর গর্ভে শত্রুর সন্তান প্রদানের মধ্য দিয়ে, নারীকে ধর্ষণের মাধ্যমে অপবিত্র করে সমাজচ্যুত করবার মধ্য দিয়ে হানাদারবাহিনী আদতে সমাজ কাঠামো ভেঙে ফেলবার রাজনৈতিক লক্ষ্যেই পুরুষালি ধর্ষণ ক্ষমতা ব্যবহার করে (শুভ্রা, ২০০৮)। এই প্রেক্ষিতে নারীবাদীরা ধর্ষণকে নির্যাতনের একটি রূপ হিসেবে চিহ্নিত করেন এবং তাঁরা বলেন, কেবল ধর্ষণই একটি গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন ও অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার যোগ্য (রোন্ডা কোপলান ১৯৯৪)।

মুক্তিযুদ্ধের মর্দ জাতীয়তাবাদী বয়ানে একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক এই দেশের নারীদের ধর্ষণের শিকার হওয়ার নৃশংস ঘটনাকে যে বয়ানে বিধৃত করা হয়েছে, সেই বয়ানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে নারীর কর্তাসত্তা ও এজেন্সির প্রতিষ্ঠা এবং খোদ ধর্ষণেরই নতুন বয়ান হাজির করার মাধ্যমে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক সায়েমা খাতুন তাঁর গবেষনায় উল্লেখ করেছিলেন, “মুক্তিসংগ্রামের প্রথম পর্বে এবং মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্যে নারীকে সম্মুখ সারির প্রতিরোধ-যোদ্ধার চেহারায় দাঁড় করালেও যুদ্ধের অব্যবহিত পরেই তা প্রতিস্থাপন করে প্রধানত ধর্ষিত-ভগ্ন-মৃত ভিক্টিম এর চেহারায়। পরিবেশনের এই প্রক্রিয়ায় ইতিহাস থেকে তাদের গায়েব ও গুম করে দেয়া হয়েছে।” প্রশ্ন হচ্ছে, যুদ্ধের অংশ হিশেবে পুরুষ যোদ্ধার অংশগ্রহণ, শহিদ হওয়া কিংবা অঙ্গহানী ঘটা যে অর্থে যুদ্ধের বীরোচিত বয়ানের অংশ, সেই অর্থে ধর্ষণ কেন ‘লস’ বা ক্ষতির অংশ? কেন বীরোচিত অংশ নয়? কেন ও কীভাবে ‘নারীর অ্যাক্টর হিশেবে পতন ঘটল তার ভিক্টিম দশায় বিস্মরণের অতল গহবরে’ ? ১৯৭১ এর মুক্তিসংগ্রামে নারীরা জাতীয় ইতিহাসের মাত্র দু’টি বিশেষ মুহুর্তে বিস্মরণের গহবর থেকে দৃশ্যপটে ভেসে উঠেছে : এক. অতীতে-যুদ্ধাক্রান্ত ও যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের জন্য আন্তর্জাতিক মনোযোগ, সমর্থন, সহানুভূতি ও সাহায্য লাভের তাগিদে এবং দুই. বর্তমানে-যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিকে পোক্ত করা ও ন্যায্যতা দেবার জন্য (সায়েমা/২০১৫) । ‘দাম দিয়ে কেনা বাংলা’, ‘আড়াই লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে কেনা বা অর্জন করা স্বাধীনতা, ‘সম্ভ্রম দিয়ে’ পাওয়া জাতি এবং দেশ⎯ এই ভাষা-অলংকারগুলো খোদ মহান সংগ্রামের লিঙ্গ বৈষম্যমূলক সংগঠনের আকৃতিতে পূর্বনির্ধারিত হয়ে আছে (খাতুন, ২০১৫)।


পুরোনো সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা তথা দাসত্বের শৃঙ্খল মোচনের লক্ষ্যে আঠারো শতকের আশির দশকে যে মহান ফরাসি বিপ্লব (১৭৮৯) শুরু হয়েছিল, সেই বিপ্লবী আন্দোলনে নারী ও শিশুর অংশগ্রহণ বাস্তবেই নতুন যুগের উন্মোচন ঘটিয়েছিল। সেই বিপ্লবী পরিস্থিতিতেও পুরুষ সমাজ দাবিনামা তৈরি করলেন ‘ডিক্লারেশন অব দ্য রাইটস অব ম্যান’ (১৭৮৯) (Declaration of the Rights of Man-1789)। প্রতিবাদে ঝলসে উঠলেন মেরি উলস্টোনক্রাফট (১৭৫৯-৯৭)। তিনি লিখলেন A vindication of the rights of man (1790) এবং A vindication of the rights of Woman (1792).

নারীর আন্দোলন, সংগ্রাম যখন উত্তাল হয়ে উঠেছিল, তখন ১৮৩২ সালে ইংল্যান্ডে ‘পার্লামেন্টারি রিফর্ম অ্যাক্ট’-এ নারী ভোটাধিকার নিষিদ্ধ হয়েছিল। ১৮৫৭ সালে মেয়েদের কাজের দাবি নাকচ হয়ে গিয়েছিল। উদার জাতীয়তাবাদীদের বিধিব্যবস্থা ছিল এ রকম: ‘নারীরা বাইরের কাজে গেলে সাংসারিক জীবনে সংকট সৃষ্টি হয়। কাজেই ঘরেই মেয়েদের থাকা প্রয়োজন। ঘরকন্নাই মেয়েদের কাজ।’ দার্শনিক শোপেনহাওয়ার (Schopenhawer) বলেছিলেন: ‘সন্তানের জন্ম দিয়ে, সন্তান পালন করে ও স্বামীদের অধীনে থেকেই নারীরা তাদের জীবনের ঋণ পরিশোধ করবে। তাদের ইচ্ছামতো মত প্রকাশ করতে দেওয়া যায় না।’ পৃথিবীর সব দেশে এবং বাংলাদেশের সমাজে এই নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি এখনো চলমান রয়েছে।


কার্ল মার্ক্স ও ফ্রেডারিক অ্যাঙ্গেলস বলেছিলেন, ‘শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির সঙ্গেই নারীর মুক্তি জড়িত।’ মার্ক্সীয় তাত্ত্বিক ধারায় জাতীয়তাবাদকে কখনোই বড় একটা আমল দেওয়া হয়নি, বরং দাবি করা হয়েছে, জাতিকেন্দ্রিক আন্দোলনের চরিত্র নিতান্তই বুর্জোয়া। জাতি-পরিচয়ের অনুভূতিকে সে ব্যবহার করে বুর্জোয়া শ্রেণীকে ক্ষমতায় বসাতে। সে কারণে সামাজিক মুক্তির প্রশ্নে মার্ক্সবাদীরা ভিন্ন পথ নির্বাচনের পক্ষপাতী। তাঁরা বলেন, ঔপনিবেশিক শোষণ থেকে মুক্তি পেতে হলে জাতীয় পরিচয়ের বদলে আন্দোলন হওয়া চাই শ্রেণীভিত্তিক। শ্রেণী-পরিচয় জাতি-পরিচয় থেকে ভিন্ন। শ্রেণীর মধ্যে আছে সর্বজনীনতা। সে বিশ্বের সব মানুষকে শোষিত শ্রেণীর পরিচয়ে একত্র করতে পারে। সেখানেই মানুষ সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ হয় বুর্জোয়া শ্রেণীকে প্রতিপক্ষ ভেবে। আর তাতেই রয়েছে প্রকৃত মুক্তি। সে তুলনায় জাতি-পরিচয়ে রয়েছে মানুষকে খণ্ডিত করে দেখার প্রবণতা।


আমাদের বীর নারীদের বেশির ভাগই হয়তো জীবিত নেই। তাঁরা সঙ্গে নিয়ে গিয়েছেন সেই মূল্যবান ইতিহাস। একটি দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের নিপীড়নের ইতিহাস। সেই ইতিহাসের বেশির ভাগই আবৃত ‘ইজ্জতের’ ঘোমটায়। আসুন, আমরা এই বয়ান থেকে বের হয়ে আসি সকলে, মুক্তিযুদ্ধের শুধু His-Story নয় , Her-Story জানি, জানাই এবং স্বীকৃতি দেই।

তথ্যসূত্র:
ইব্রাহিম, নীলিমা, ১৯৯৫ (১৯৯৪), আমি বীরাঙ্গনা বলছি (১ম ও ২য় খÐ), জাগৃতি, ঢাকা।
গায়েন, কাবেরী, ২০১৩, মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রে নারী-নির্মাণ, বেঙ্গল পাবলিকেশনস লিমিটেড, ঢাকা।
গুহঠাকুরতা, মেঘনা, ১৯৯৫, নারীবাদী দৃষ্টিতে ধর্ষণ ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন, সমাজ নিরীক্ষণ, সংখ্যা ৫৮, ঢাকা, সনিকে প্রকাশনা।
শুভ্রা, ফাতেমা সুলতানা, ২০০৮, অভিজ্ঞতায় ধর্ষণ: বহুমাত্রিক সহিংসতা ও নারী জীবনের পুনর্গঠন, (অপ্রকাশিত) স্নাতক পর্যায়ের একাডেমিক গবেষণা থিসিস।
গুহঠাকুরতা, মেঘনা, ১৯৯৮, সহিংসতা এবং নিপীড়ন: নারী আন্দোলনের প্রক্রিয়া, সমাজ নিরীক্ষণ, সংখ্যা ৬৬, ঢাকা, সনিকে প্রকাশনা।
সায়েমা খাতুন (২০১৫), মুক্তিযুদ্ধের HIS-STORY : ইজ্জত ও লজ্জা ; দৃক, ঢাকা
Brownmiller, Susan, 1975, Against Our Will: Men, Women and Rape, Simon and Schuster, New York