এই ডাকটার মধ্যে একটা আর্তি আছে।
আজ সেই ঐতিহাসিক “মুল্লুক চলো” আন্দোলনের ১শ বছর। রাষ্ট্রীয়ভাবে আজকের দিনটিকে “চা শ্রমিক দিবস” স্বীকৃতি দেবার জন্য লড়াই করে যাচ্ছেন চা শ্রমিকরা।
বলা হয়ে থাকে এই ন্যাক্কারজনক গণহত্যাকে হাপিস করে দেওয়াটা ব্রিটিশদের অন্যতম টার্গেট ছিল। না হলে গোর্খাবাহিনীর গুলিতে ৭ হাজারের বেশি শ্রমিক মরে যাওয়া এই আন্দোলন কেন জনমানুষের কাছে এত কম প্রচারিত!
ব্রিটিশ শাসকের দালালগুলো পুরুলিয়া, বিহারসহ মধ্য ভারতের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর কাছে গিয়ে গিয়ে বলত “চা শ্রমিক হবার কথা”। চা শ্রমিক হলে মাটি উড়ালেই টাকা আর টাকা। উন্নত জীবনব্যবস্থার স্বপ্ন আর সারাজীবন কাজের প্রত্যাশায় এই মানুষগুলোকে নিয়ে আসা হয়।
তারা এসে দেখে ভরা জংগল। তা কেটে সাফ করে চা এর মত অর্থকরী ফসল চা গাছ লাগাতে হবে। তারা দেখতে পারে ওইসব আশাটাশা সব ভুয়া। মধ্যযুগের দাসদের কায়দায় তাদের খাটানো হচ্ছে। পাহাড় জংগলের পরিবেশ এর সাথে খাপ না খাওয়াতে পেরে, মশার কামড় খেয়ে বড় অসুখ বাঁধিয়ে কোন ন্যুনতম চিকিৎসার সুযোগ না পেয়ে বিশাল সংখ্যক শ্রমিক মারা যেতে থাকে।
এসব বঞ্চনার ফলেই ত্রিশ হাজার শ্রমিক একসাথে ফিরে যাবার চিন্তা করে নিজেদের মুল্লুকে। ১৯২১ সালে ৩ মে তারা যাত্রা শুরু করে। ব্রিটিশ রেলওয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়। তারা হাঁটা শুরু করে চাঁদপুর স্টীমার ঘাটের দিকে। লক্ষ্য মেঘনা পার হয়ে নিজ দেশে যাওয়া।
সেই স্টীমার ঘাটে ২o মে চা শ্রমিকদের জমায়েতের উপর ব্রিটিশদের নিয়োজিত সেনাবাহিনী ( অনেক জায়গায় উল্লেখিত ব্রিটিশদের নিয়োজিত আসাম গোর্খাবাহিনী( গুলি ছড়ে। নির্মমভাবে হত্যা করা হয় তাদের। ওই স্টীমার ঘাটে জমায়েতের সময় শ্রমিকদের শুকনো খাবার দিয়ে সহায়তা করেছিলেন চাঁদপুর এর আইনজীবী এবং কংগ্রেস কর্মী হরদয়াল নাগ। এই গণহত্যায় ফেটে পড়ে চাঁদপুর, ঢাকাতেও তখন হরতাল দেওয়া হয়।
এরপর বেঁচে থাকা শ্রমিকদের সংগে মালিকপক্ষের আপোষ হয় এবং তার ফলাফল ব্রিটিশরা চলে গেলেও আজো ব্রিটিশ কলোনাইজড এর একদম প্রকৃষ্ট উদাহরণ হয়ে আছে চা বাগান। এখানে এখনো বড় সংখ্যক চা বাগানের মালিক সেই ব্রিটিশ আমলের ডানকান ব্রাদার্স। এবং বাংলাদেশী ব্যক্তির মালিকানা আসলেও চা শ্রমিকদের উপর ঔপনিবেশিক শাসন এখনো বর্তমান।
বাংলাদেশের সবচেয়ে ন্যুনতম শ্রমিক পায় চা বাগানের শ্রমিকরা। দিনে মাত্র ১শ দুই টাকা। যেখানে ২o১৯ সালের সমীক্ষা অনুযায়ী ওই বছরে বাংলাদেশের চা ইন্ডাস্ট্রি থেকে আয় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা।
ভাবেন, বাগানের সব চা শ্রমিকরা একদিন কাজ বন্ধ করে দিলে চা শিল্পে অন্তত একদিনে দেড়শ কোটি টাকা লস হওয়া সম্ভব! কিন্তু কোনদিনই তারা এই কাজ করার কথা ভাবেও না। তাদের এই নিপীড়নের জীবন বেশিরভাগের কাছে অখন্ডনীয় “ভবিতব্য” হিসেবে গৃহীত হয়ে গেছে।
কিংবা বঞ্চিত হতে হতে এমন জায়গায় চলে গেছে প্রতিরোধের ক্ষমতা ভুলে গেছে! বা এও হতে পারে পন্ডিত গঙ্গাচরণ দীক্ষিতে বা পন্ডিত দেওশরণের মত কাউকে খুঁজছে যার ডাক পেলে ত্রিশ হাজার শ্রমিক মুল্লুক চলে যাবার মত ভাংচুরের সিদ্ধান্ত নিতে পারে!
কঠিন থেকে কঠিন বিষয় হচ্ছে, এই চা বাগানের প্রান্তিক শ্রমিক শ্রেণীর এখনো বড় কোন আন্দোলন না গড়ে উঠার কারণ এখানকার lumpen চরিত্রের দালাল শ্রমিকরা।
তারা মালিকপক্ষের সাথে আপোষ করে, মালিকদের সংগঠন এর সাথে আপোষ করে সরকারের সাথে আপোষ করে নিজে “উন্নত” জীবন পায় আর শ্রমিকদের কে ‘শান্ত’ থাকতে বলে।
অথচ এই শ্রমিকদের ইতিহাস আছে নিজের অধিকারের লড়াইয়ে আপোষ না করে দুর্নিবার হয়ে জীবন পর্যন্ত দেবার। কিন্তু আজ তারা দালালচরিত্রগুলোর বিরুদ্ধেই দাঁড়াতে পারে না, বরং তাদের সহযোগী মাধ্যম হয়ে উঠে। কখনো অজান্তেই।
এখানেই “মুল্লুক চলো” এর এই একশ বছরের spirit নাই হয়ে যায়।
আজকের দিনে আমাদের একটাই আওয়াজঃ ২o মে কে চা শ্রমিক দিবস হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দাও এবং চা শ্রমিকের ন্যুনতম দৈনিক মজুরি ৫শ টাকা ঘোষণা কর।
Be the first to write a comment.