
সম্প্রতি ভালোবাসা দিবসে ভাইরাল হওয়া সোহেল মিয়ার পর পর দুটি ঘটনা জনমনে বেশ আলোড়ন তুলেছে। দু দিন আগেই যে ছিলো নায়ক, দুদিন পরেই সবাইকে রীতিমতো তাজ্জব বানিয়ে হয়ে গেলো খলনায়ক। আলোড়ন তোলার মতোই ঘটনা। কিন্তু আমি ঘটনাটা দেখছি সোহেল মিয়া ওরফে মোখলেছুর রহমান বকুলের দিক থেকে। এই সোহেল মিয়া এখন আমাদের চোখে যত বড় ঠগ, জোচ্চুর, প্রতারকই হোক না কেন, তার জীবনটা আসলে কেমন ছিলো? সুখের সন্ধান কি সে আদৌ পেয়েছে? ঋণগ্রস্থ মোখলেছুর তার প্রথম স্ত্রী ও চার সন্তানের কাছ থেকে উধাও হয়ে গেলো। স্ত্রী সন্তান সহ ঋণগ্রস্থ হবার যন্ত্রণা কম নয়।
কে জানে, অভাবের সংসারে ঐ স্ত্রী কত বার তাকে মুখ ঝামটা দিয়েছে। চার সন্তানের খরচ বহন করতে পারে না বলে কতবার মোখলেছুরের পুরুষত্বকে প্রশ্নে খোঁটা দিয়েছে, আমরা সেসব জানি না। কতদিন তার স্ত্রী রাগে দুঃখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছে, এমন স্বামীর ঘর করতে হচ্ছে বলে, সে খবরও আমরা রাখি নি। অভাবের সংসারে স্ত্রীর এমন অভিযোগ অনুযোগ করাটাই বরং বেশি স্বাভাবিক। মোখলেছুর জানতো, এমন একটা জীবন সে পেয়েছে, এর থেকে মুক্তি পাওয়া এত সহজ নয়। তাই সে উধাও হয়ে গেলো একদিন , যেভাবে সিদ্ধার্থ পূর্ণিমার রাতে ঘর ছেড়েছিলো। এরপর সে আর পেছনে ফিরে তাকায় নি। কারণ, ওদিকে তাকাতে তার ভয় লাগতো। স্ত্রী সন্তানকে অকূল পাথারে এমন ভাবে ফেলে এসেছে, ওসব হয়ত সে ভাবতেও চায় নি আর।
নিজের মতো আলাদা একটা সত্তা সে তৈরি করে হয়ে গেলো সোহেল মিয়া। টাকার গায়ে মোবাইল নং পেয়ে সে ভালো উদ্দেশ্য নিয়ে কল করেছে, এরকম অবশ্য মনে হয় না সাদা চোখে। অতি কৌতুহল, নিজের একাকিত্ব থেকেই হয়তো সে কলটা করেছিলো। আর এরপর পরিচয় হয়ে গেলো প্রতিবন্ধী রওশনের সাথে। মেয়েটি প্রতিবন্ধী, এ তথ্য জানার পরেও সোহেল মিয়া তাকে সত্যিই ভালোবাসলো, বিয়ে করলো। একেবারে রিভার্স কুবের। কুবের তার পঙ্গু স্ত্রী মালাকে পেছনে ফেলে চঞ্চলা চপলা সুস্থ স্বাভাবিক কপিলাকে নিয়ে পাড়ি জমিয়েছিলো ময়নাদ্বীপের উদ্দেশ্যে। এখানে ঘটলো উলটো ঘটনা। সুস্থ স্বাভাবিক স্ত্রীকে পেছনে ফেলে সোহেল মিয়া প্রতিবন্ধী রওশনকে নিয়ে রচনা করলো তার নিজস্ব ময়নাদ্বীপ। ময়নাদ্বীপে কুবের যেমন পালিয়ে গিয়েছিলো, সোহেলও বিয়ের জন্য লুকিয়ে অপেক্ষায় ছিলো রওশনের। কপিলা সাহসী , তাই নির্দ্বিধায় অজানা ময়নাদ্বীপে রওনা হতে রাজি হয়ে গিয়েছিলো। ঠিক তেমনি প্রতিবন্ধী রওশনও তার চূড়ান্ত সৎ সাহসের উদাহরণ সৃষ্টি করে অজানার পথে পা বাড়ালো। সোহেলের নিজস্ব ঠিকানা না থাকায় এবার রওশনের বাড়িতেই থাকার সুযোগ পেয়ে গেলো। নিজের অস্বিত্ব রক্ষায় তাকে মিথ্যাচারও করতে হলো নিজ অতীত নিয়ে। নিজের কষ্টকর অতীতকে মুছে ফেললো নতুন অতীত সৃষ্টি করে। সৃষ্টি হলো নতুন ময়নাদ্বীপও।
রওশন প্রতিবন্ধী হলেও তার ভালোবাসা, সারল্য , সোহেলের প্রতি বিশ্বাস যেকোন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের চেয়েও প্রগাঢ় ও বিশুদ্ধ। অনেক ঝুঁকি আছে, জেনেও সেদিন সে বিয়ের জন্য পালিয়ে গিয়েছিলো। সবাই তাকে বলেছিলো, দেখিস, বাচ্চা হলেই দুদিন পরে তোকে ফেলে চলে যাবে। কিন্তু ১৫ বছর ধরে সোহেল তাকে আগলে রেখেছে। স্বপ্নেও যা দেখতে ভয় পেতো , সব বাস্তব হয়ে ধরা দিতে শুরু করলে রওশনের আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে। পৃথিবী জয় করে ফেলার আনন্দ নিয়ে গর্বে মাথা উঁচু করে চলতে শেখে। অথচ, তার জানা ছিলো না, বাচ্চাকাচ্চা হবার পর একজন নারীকে ফেলে সোহেল সত্যিই চলে এসেছে! এমন অতীত জানা থাকলে রওশন সোহেলকে ভালোবাসতো না। তাই এ তথ্য গোপন রেখেছে সোহেল। একটা জলজ্যান্ত অতীতকে রীতিমতো গিলে হজম করা কম কথা নয়। ঠিক এই জায়গাটিতে সোহেল যে কতটা নিঃসংগ ও একা একজন মানুষ, আমরা ধারণাও করতে পারবো না।
জনবিচ্ছিন্ন ময়নাদ্বীপে বাস করা কুবের কপিলার জন্য ছিলো কষ্টকর। সোহেল রওশনের ভালোবাসার ময়নাদ্বীপেও অভাব অনটন। সংসারের প্রতিটি কাজই সোহেলকে একাই করতে হয়েছে। এমন তো নয় মিথ্যা বলে, প্রতারণা করে বিলাসবহুল জীবন সে পেয়েছে। সে যেদিকে গিয়েছে, অভাব পিছু ছাড়ে নি। চুপচাপ পরিশ্রম করে গিয়েছে সে দিনের পর দিন। আর একজনকে দিয়েছে ভালোবাসার রাণী হবার সুখ। অথচ এই সোহেলের প্রথম স্ত্রীর ছিলো হাজারটা অভিযোগ, ভালোবাসার দাম দিতে পারে নি। আর সরলমনা রওশন অভাবের মধ্যেও ভালোবাসার মূল্য দিতে পেরেছে পুরোটুকুই। নিজে যেমন রাণীর মর্যাদা পেয়েছে, তেমনি সোহেলকেও সে দিয়েছে রাজার মর্যাদা। এতটুকু অভিযোগ অনুযোগ , অবিশ্বাস মনে জায়গা দেয় নি। তাই প্রতিবন্ধী হলেও রওশনকে ছেড়ে যায় নি সে।
দিনশেষে এটি শেষ পর্যন্ত ভালোবাসারই কাহিনী। কিন্ত ততদিনে রওশনের কানেও নিশ্চয়ই সোহল ওরফে মোখলেছুরের প্রতারণার কাহিনী পৌঁছেছে। কত বড় মিথ্যেকে এতদিন সত্য জেনে সুখে সে বাস করছিলো। আজ সত্যি সত্যটা জেনে রওশন পারবে, সোহেলকে আগের মতোই ভালোবেসে যেতে?
মোখলেছুরের প্রথম স্ত্রী ও চার সন্তান এতদিনে একা বেঁচে থাকার সংগ্রাম শিখে গিয়েছে। ভালোবাসাহীন একটি সংগ্রামী জীবন যাপন করেই আজ সে অভ্যস্ত। কোন মোখলেছুরকে আজ তার আর দরকার নেই। কিন্তু রওশন?
আজ সবাই মোখলেছুর ওরফে সোহেল মিয়ার প্রতারণার বিচার চাইছে। বিচার অবশ্যই হওয়া দরকার। কিন্তু তাই বলে তার ভালোবাসাকে ছোট করবেন না। একজন ঠগ, প্রতারক, জুচ্চোরও ভালোবাসতে জানে। রওশনের মতো কারো জীবনে একজন প্রতারকের ভালোবাসারও দরকার আছে। কারণ, সোহেল আর যা-ই করুক না কেন, তার ঐ ভালোবাসায় ভেজাল ছিলো না। বলেন, ছিলো কি?
সোহেল রওশনের ময়নাদ্বীপে আমরা আর হামলা না চালাই।

Be the first to write a comment.