১. ভূমিকা
“জ্ঞাতিসম্পর্ক” পড়ানো
সাত বছর শিক্ষাছুটিতে থাকবার পর ’৯৬ এর গোড়ার দিকে রেহনুমা আহমেদ যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে আবার যোগদান করে, তখন তার পড়াবার বিষয় নির্ধারিত হয় “জ্ঞাতিসম্পর্ক” কোর্সটি। কিন্তু যেহেতু তার পি.এইচ.ডি. থিসিসের কাজ শেষ হয়নি, তাই বিভাগীয় শিক্ষকেরা তার লেখাপড়ার সময় করে দেয়ার জন্যে বিভিনড়বভাবে সহায়তা করবার সিদ্ধান্ত নেয়। প্রাথমিকভাবে “জ্ঞাতিসম্পর্ক” কোর্সটি পড়াতে শুরু করে মানস চৌধুরী। এটি প্রম বর্ষের পাঠ্যসূচীর বিষয়। মানস এই কোর্সটির বিষয়বস্তু দাঁড় করানোর ক্ষেত্রে প্রচলিত ধারা হতে শুরু করে মর্গান, এঙ্গেলস পড়ায়। পরবর্তীতে কোর্সটির
বিষয়বস্তু বদলানোর ক্ষেত্রে রেহনুমা এবং মানস সাম্প্রতিক নৃবিজ্ঞানের তত্ত্ব নিমার্ণ (ঃযবড়ৎরংধঃরড়হ)-কে প্রাধান্য দেয়।
উপনিবেশকালীন সময়ে জ্ঞানকাণ্ড হিসেবে নৃবিজ্ঞানের সূচনা হয়েছে। নৃবিজ্ঞানের অর্থই ‘অন্য’কে অধ্যয়ন; আর অন্য মানেই আদিম অর্থাৎ অপাশ্চাত্য সমাজ Ñ এই উপলব্ধির মুখোমুখি হওয়া জরুরী ছিল কোর্সটিতে। কারণ, এই ‘অন্য’ পশ্চিমের কাছে অন্য। যখন বিংশ শতকের শেষভাগে প্রাšি ক পুঁজিবাদী দেশগুলোতে নৃবিজ্ঞানের ঐতিহাসিক গঠন নিয়ে বিতর্ক করে বিভিনড়ব ধরনের ধারা ও কাজ জন্ম নিচ্ছে Ñ তখন পশ্চিমের ক্ষমতা সম্পর্ক না বুঝে নৃবিজ্ঞান চর্চা সম্ভব নয়। তাই প্রয়োজন পড়ে পশ্চিমকে অধ্যয়ন করার।
জ্ঞাতিসম্পর্ক কোর্সটিকে সাজানো হয় দুটো ভাগে ভাগ করে। এক ভাগে রাখা হয় ঊনবিংশ শতাব্দীর কাজগুলো যেখানে মর্গান, মেইন, এঙ্গেলস বিবেচিত হয়। অন্যভাগে বিংশ শতাব্দীর নানাবিধ কাজকে তালিকায় নিয়ে আসা হয়। এর মধ্যে লিওনোর ডেভিডফ ও ক্যাথরিন হল, μিি€ন ডেলফি, হিলারী স্ট্যান্ডিং এবং তালাল আসাদের কাজ এসেছে।১ এই নির্বাচনের ক্ষেত্রে একটা বিষয় খেয়াল রাখা হয়েছে যে বিংশ শতকে ‘জ্ঞাতিসম্পর্ক’ আলোচনায় জোরদার বিশেষণী কাজগুলো এসেছে নারীবাদীদের হাত থেকে। এর মধ্যে অগ্রণী কাজগুলো নৃবিজ্ঞানের বাইরের, যদিও ধরেই নেয়া হ’ত জ্ঞাতিসম্পর্ক বিশেষভাবেই নৃবিজ্ঞানের বিষয় এবং কেন্দ্রীয় বিষয়।

ছাত্রছাত্রীদের দলগত উপস্থাপনার দায়িত্ব দিয়ে পড়ানো হচ্ছিল। এমন নয় যে দলগত উপস্থাপনাই পড়ানোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে কার্যকরী পদ্ধতি, কিন্তু প্রাগত বক্তৃতা পদ্ধতিতেই শুধু পাঠদান করলে একঘেয়ে হয়ে পড়তে পারে এরকম মনে হচ্ছিল। এ ধরনের উপস্থাপনায় সমন্বয়ের কাজ স্বাভাবিকভাবেই কোর্স শিক্ষককে করতে হয়েছে। প্রম বর্ষের ছাত্রছাত্রীদের একাধিক দলে ভাগ করে বিভিনড়ব লেখা বিভিনড়ব দলের দায়িত্বে দিয়ে দেয়া হয়। শুধু সমন্বয়ই নয়, দায়িত্ব অন্যত্রও। সচরাচর বাংলা মাধ্যমে পড়া এই ছাত্রছাত্রীদের ইংরেজী লেখা থেকে উপস্থাপনযোগ্য লেখা তৈরী করতে হয়েছে। তাদের সেই কাজে সহায়তা দেয়া জরুরী। তাই বারংবার শুধু ছাত্রছাত্রীদের সাথেই নয় বরং রেহনুমা ও মানসের একত্রে বসতে হয়েছে। অনুবাদের জন্য, ছাত্রছাত্রীদের বিষয়বস্তু ধরিয়ে দেবার জন্য।
আমাদের এই যৌথতা ‘জ্ঞাতিসম্পর্ক’, সেই সাথে নৃবিজ্ঞান নিয়ে অনেকগুলো জিজ্ঞাসার জন্ম দেয়। তৃতীয় বিশ্বের ক্ষমতাহীন ঐতিহাসিক বা¯ বতার মধ্যে নৃবিজ্ঞান চর্চা করতে গিয়ে সেই জিজ্ঞাসাগুলোর অনুশীলন অত্যš জরুরী। বিংশ শতাব্দীতে বেশ কিছু জ্ঞাতিসম্পর্কের গবেষণা কাজ হয় যেগুলো শ্রেণীকরণ, বর্ণনাম লক জ্ঞাতিসম্পর্ক অনুসন্ধান করে। র্যাডক্লিফ-ব্রাউনিয়ান সেই কাজগুলো জ্ঞাতিসম্পর্ক অধ্যয়ন করার ক্ষেত্রে কতটা অর্থ বহন করে ? লিঙ্গ এবং শ্রেণী সম্পর্ক কিভাবে জ্ঞাতিসম্পর্কের কেন্দ্রীয় বিষয় হিসেবে বিবেচিত হতে পারে? যৌনতা (ংবীঁধষরঃু) কি, যেমনটা প্রচলিত
দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা হয়, প্রাকৃতিক, স্বাভাবিক, অপরিবর্তনীয় কিছু, না কি একটি ঐতিহাসিক প্রপঞ্চ? যদি এটা ঐতিহাসিক, তাই অনিবার্যভাবেই রূপান্তরশীল হয়, তাহলে পরিবর্তিত আধিপত্যের সম্পর্ক (পুরুষ, শ্রেণী ও পাশ্চাত্য) কিভাবে যৌনতাকে পুনর্নির্মাণ করে? কোন্ ঐতিহাসিক বাস্তবতায় বিশেষ ধরনের যৌনতা, বিয়ে এবং পারিবারিক সম্পর্ক শক্তিশালী হয়ে ওঠে, একমাত্র নৈতিক হয়ে ওঠে? অপাশ্চাত্য থেকে পাশ্চাত্য অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামরিক, এমনকি মতাদর্শের ক্ষেত্রেও শক্তিশালী। পাশ্চাত্যের এই ক্ষমতা জ্ঞানকাণ্ড হিসেবে নৃবিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠায় মদদ যুগিয়েছে। তাহলে আজকে অপাশ্চাত্যে, বাংলাদেশে নৃবিজ্ঞান চর্চা করতে গিয়ে বিষয়বস্তু এবং তাত্ত্বিক পরিকাঠামোর দিক নির্দেশনাটা কী হবে?
নৃবিজ্ঞান কি ‘অন্য সংস্কৃতির’ অধ্যয়ন নাকি ‘পাশ্চাত্য সাংস্কৃতিক হেজেমনি’র অধ্যয়ন ?
“I believe, also, that it is more important today than it has ever been before in human history for people to have some understanding of cultures other than their own.”2
জন বিটি’র এই উদ্ধৃতি থেকে প্রম পর্যায়ের নৃবিজ্ঞানের একটা চেহারা ধরা পড়ে। নৃবিজ্ঞান চর্চার তাগিদ তৈরী হয় পশ্চিমে। সংস্কৃতির অন্যতা খোঁজা এবং তার বিশে- ষণ নিয়ে নৃবিজ্ঞানের শুরু। কিন্তু কেন এই অন্যতাকে আবিষ্কার করা পশ্চিমের জন্য জরুরী হয়ে পড়েছিল Ñ তা নিয়ে ধ্র“পদী নৃবিজ্ঞানের মতামত যথেষ্ট প্রশড়বাতীত বিবেচনা করা কঠিন। বিটি থেকেই তুলে ধরা যাক আবার ঃ
“…by adding a little more to that knowledge of human society and culture, and so to our knowledge of ourselves, it may help us to understand some of these problems better,”৩
এই অনুধাবন থেকে যে প্রশড়বটা সরাসরি চলে আসে তা হল অন্যতাকে দেখার প্রশড়ব, কিংবা সঠিকভাবে বললে অন্যতাকে নির্মাণের প্রশড়ব। সেই নির্মাণের ক্ষেত্রে পশ্চিমের অর্থাৎ ক্ষমতাবানের কর্তকৃ কোনভাবেই উপরের উদ্ধতৃ লেখাগুলোতে উন্মোচিত হয় না। পাশ্চাত্যের ক্ষমতাকে বিটি এবং আরো অনেক নৃবিজ্ঞানীদের লেখায় নিপুনভাবে অদৃশ্য
করে ফেলা হয়।৪ কিছুতেই দেখতে দেয়া হয় না “অন্য” বানাবার পুরো প্রক্রিয়ায় নির্মাতা/কর্তা কে ? “Our”-এর “আমরা” কারা ? আমরাও, অপাশ্চাত্যরাও কি Our–এর অন্তর্ভুক্ত ? “Human society”-”-র সদস্য কারা ? কোন সমরূপতা (homogeneity) আছে কি পাশ্চাত্যের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নৃবিজ্ঞানীর আর অপাশ্চাত্যের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক
নৃবিজ্ঞানীর যেমন আমরা ? একই “অন্য” কে আমরা উভয়েই নির্মাণ করতে পারি কি ?
অন্যতা যে প্রবল দ্বারা নির্মিত এবং মতাদর্শিক পরিসরে সেই অন্যতা কাজ করে সবচেয়ে জোরালভাবে এটা উপলব্ধি করতে পারে নারীবাদীরা।৫
লিঙ্গীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে পুরুষ প্রাবল্য বিদ্যমান। নারীর জন্য এবং নারীবাদীদের জন্য
সেটা বস্তুগত (material) । আবার মতাদর্শিকও। এই বস্তুকতা ও মতাদর্শ পুরুষ কেন্দ্রীক। শ্রমব্যবস্থা এবং লিঙ্গীয় পরিচয়ে (gender identity) নারী হয়ে পড়ে “অন্য” অপাশ্চাত্যের “অন্য” হয়ে পড়ার অভিজ্ঞতা আলাদা। ঊনবিংশ শতাব্দীতে নৃবিজ্ঞান চর্চা করতে গিয়ে পাশ্চাত্য বিবর্তনবাদী কাঠামো দিয়ে অপাশ্চাত্যের ইতিহাস বানায়। সেটা আবার ঐতিহাসিকতার শর্তগুলোকে অনুপস্থিত রেখেই। পাশ্চাত্য এবং অপাশ্চাত্য এই প্রক্রিয়াতে যুক্ত থাকে অসম এবং খুবই ভিন্ন অবস্থান হতে। পাশ্চাত্য নিজেকে নির্মাণ করেছে অপাশ্চাত্যের সাপেক্ষে তার “বড়’’ ও “উন্নত’’ চেহারাকে, নিজেকে “প্রগতির চূড়ায়” রেখে। আবার সেই ইতিহাসে অপাশ্চাত্য থাকে যা “আদিম”, “বর্বর”, “অসভ্য”।৬ এই ইতিহাস বানানোর প্রকল্প বিংশ শতাব্দীর বিশ, তিরিশ ও চল্লিশের দশকে বদলে যায় যখন এশিয়া ও আফ্রিকার ঔপনিবেশিত মানুষজন ঔপনিবেশিক শাসন মুক্ত হতে চায়।
অপাশ্চাত্যের মানুষজনকে উপলব্ধি করবার জন্য নতুন ক্যাটাগরি সৃষ্টি হয়। “ট্রাইব্যাল”, “অনাধুনিক”দের “আধুনিক”, “নাগরিক” পর্যায়ে কিভাবে “উত্তরণ’’ ঘটানো যায় তা নিয়ে নৃবিজ্ঞানে তর্কবিতর্কের সূচনা হয়।৭ তাই পশ্চিমের উপস্থিতি বাদ দিয়ে আজকের নৃবিজ্ঞান, পাশ্চাত্যে বা অপাশ্চাত্যে, চর্চা সম্ভব নয়। প্রশড়ব হ’ল কোন্ ইতিহাস তাহলে নৃবিজ্ঞানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ? তালাল আসাদের মতে নৃবিজ্ঞান হতে হবে ঐতিহাসিক, পাশ্চাত্য সাংস্কৃতিক হেজেমনির অনুসন্ধান হবে তার লক্ষ্য। আসাদের ভাষায়:
“Anthropology, then, appears to be involved in definitions of the West while Western projects are transforming the (preliterate, precapitalist, premodern) peoples that ethnographers claim to represent. Both processes need to be studied systematically. To understand better the local peoples “entering” or (“resisting”) modernity, anthropology must surely try to deepen its understanding of the West as something more than a threadbare ideology. To do that will include attempting to grasp its peculiar historicity, the mobile powers that have constructed its structures, projects and desires.”৮
অপাশ্চাত্যের রূপান্তর বুঝবার জন্য সেই ধরনের ঐতিহাসিকভাবে নির্দিষ্ট কাজ প্রয়োজন যা অপাশ্চাত্যের মানুষজনের বিবিধ ইতিহাস Ñ শ্রমবিভাজন, সম্পদের সাথে সম্পর্ক, রীতিনীতি, মূল্যবোধ, বিশ্বাস-কে “প্রাক-পুঁজিবাদী’’ লেবেল এঁটে “সমরূপ’’ (homogeneous) করবে না।৯ একটি জনসমষ্টির বিশিষ্ট, নির্দিষ্ট বাস্তবতাকে কিভাবে পাশ্চাত্যের ক্ষমতা রূপান্তর করছে সেটাই অনুসন্ধানের বিষয়। প্রায়শই এই রূপান্তরণ অপাশ্চাত্যের জনগণের কার্যকারিতা (agency)আছে, তারা কোনও ভাবেই নিস্ক্রিয় নয়।
২. ইংরেজী হ’তে বাংলায় লিঙ্গ এবং শ্রেণীর অনুবাদ
ডেভিডফ ও হল, পরিবার গঠনে বিয়ের ভ‚মিকা ঃ
ইংল্যান্ডে সমাজতন্ত্রী ইতিহাসবিদদের কাজের ধারা অত্যন্ত শক্তিশালী। ই. পি. টমসন, এরিক হবস্বম এদের মত বলিষ্ঠ তাত্তি¡করা এই ধারা দাঁড় করিয়েছে।১০ রাষ্ট্র, শ্রেণী, শ্রেণীসম্পর্ক, সাম্রাজ্যবাদ Ñ তাদের কাজের প্রধান জায়গা। সে সমস্ত কাজে শ্রমিক শ্রেণীর ইতিহাস পুনর্নির্মাণ, শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাস রচনা পাওয়া যায়। কিন্তু তাদের এবং অন্যান্য সমাজতন্ত্রী ইতিহাসবিদদের কাজে নারী শ্রমিকদের উপস্থিতি অত্যন্ত প্রান্তিক।১১ লিওনোর ডেভিডফ এবং ক্যাথরিন হল নারীবাদী ইতিহাসবিদ। তাদের দুজনের যৌথ কাজের ফসল Family Fortunes. Men and Women of the English Middle Class, 1780-1850|১২ দুটো চিন্তা তাদের মাথায় কাজ করেছে ঃ লিঙ্গীয় সম্পর্কের সামাজিক সংগঠন(“the social organisation of relations between the sexes”),১৩ এবং শ্রমিক শ্রেণী নয়, অধিপতি শ্রেণীর অধ্যয়ন। সে কারণেই কাজটি বৃটিশ সমাজতন্ত্রী ইতিহাসবিদদের প্রচলিত ধারা হতে ভিনড়ব। আঠারো শতকের শেষভাগ হতে উনিশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত ইংরেজ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মতাদর্শ, প্রতিষ্ঠান এবং
অনুশীলন নিয়ে তাদের বইটি।১৪ ষাট এবং সত্তরের দশকে পাশ্চাত্যে যে নারীবাদী তাত্ত্বিকী কাজ হয়েছে লিঙ্গ এবং শ্রেণী বিষয়ে, তার ভিত্তিতে এই বইটির সূচনা।১৫ ডেভিডফ ও হল দেখেছে লিঙ্গ এবং শ্রেণী সব সময়েই একত্রে μিয়াশীল এবং শ্রেণী চৈতন্যের সবসময়ই একটা লিঙ্গীয় রূপ আছে। অবশ্যই শ্রেণী পরিচয় এবং লিঙ্গীয় পরিচয় একীভ‚ত হয় না। সত্যিকার অর্থে, শ্রেণী প্রত্যাশা এবং নারী সত্তার ভেতর একটা বিরোধ কাজ করেছে। উনিশ শতকের মাঝভাগে নারীবাদ বিকাশে সেই বিরোধ শক্তিশালী ভ‚মিকা রেখেছে।
মধ্যবিত্ত দুনিয়ার প্রত্যক্ষ পাবলিক-প্রাইভেট (ঘর-বাহির) বিভাজনকে আলাদাভাবে মনোযোগ দিয়েছে তারা। রাজনৈতিক অঙ্গনে রাষ্ট্র এবং ব্যক্তিস্বার্থের যে বিভাজন Ñ সে অর্থে নয়, পার্থক্যটা সাধারণ বুদ্ধির। একদিকে নৈতিকতা ও আবেগের রাজ্য, অন্যদিকে যুক্তিশীল কর্মকাণ্ড যাকে বাজার ব্যবস্থার চালিকাশক্তি হিসেবে দেখা হয়। এ পাবলিক-প্রাইভেট বিভাজনের বাইরে তারা দেখাতে চেয়েছে ধনসম্পত্তি এবং মানুষজন নিয়ন্ত্রণের সামর্থ্যরে কারণে কেউকেটা হয়ে ওঠা মধ্যবিত্ত পুরুষেরা কিভাবে পারিবারিক সম্পর্ক জালে আবদ্ধ ছিল এবং নারীরা তাদের খ্যাতিতে সহায়তা যুগিয়েছে। পুঁজিবাদী বাণিজ্য বিকাশের ক্ষেত্রে পারিবারিক লিঙ্গীয় শ্রম বিভাজনের কেন্দ্রীয় ভূমিকা বইটি বিশ্লেষণ
করে। পূর্বতন ঐতিহ্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত নতুন লিঙ্গীয় ভিন্নতার ধারণাগুলো চিহ্নিত করতে এবং ওই ধারণাগুলোর সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রভাব অনুসন্ধান করেছে তারা।
পুঁজিবাদী রূপান্তরের মধ্যে পরিবার ও বিয়েতে নারীর ভ‚মিকা পুনর্নির্ধারিত হচ্ছিল। ইহুদী-খৃস্টীয় ধারার পরিবার বৃটেনে প্রচলিত ছিল। এই পরিবারে বয়স ও লিঙ্গীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে বয়স্ক পুরুষদের আধিপত্য ছিল। বৃটিশ মধ্যবিত্ত গঠনে, পুঁজিবাদী বিকাশের মধ্যে, পরিবার তৈরীতে বিয়ে নতুনভাবে গুরুত্ব পেতে থাকে। পিউরিটান ধারার গৃহীপনায়
(domesticity) যুক্ত হয় নারীর “সহযোগী” ভূমিকার নতুন আদর্শ রূপ। যদিও এতে নারীর একটা কেন্দ্রীয় ভূমিকা তৈরী হ’ল কিন্তু নারী হয়ে ওঠে নৈতিক এবং সেই সময়কার ধর্মীয় আন্দোলনের প্রেক্ষিতে আÍিক বা স্পিরিচ্যুয়াল। মধ্যবিত্ত গঠনের মধ্য দিয়ে রক্ষাকারী এবং কর্তা হিসেবে পুরুষের ভ‚মিকা বাড়তে থাকে। বিয়ে, পুরুষের বেলায় ব্যবসা অথবা পেশাগত উপার্জনের সাথে শর্তযুক্ত হয়ে পড়ল। আগের সময়টাতে যেখানে স্বামীর চেয়ে বয়সে বড় স্ত্রী থাকা সম্ভব ছিল, বাস্তবও ছিল, ডেভিডফ ও হল দেখিয়েছে পুঁজিবাদী বিকাশে তা আর সম্ভব নয়। অরুচিকর হয়ে পড়ল। সহধর্মিণী হবে বয়সে ছোট,
নির্ভরশীল, শিশুরূপ; স্বামী হবে তার পথপ্রদর্শক, সব সময়কার পরিচালক।
ডেভিডফ এবং হলের এই কাজের পদ্ধতি সম্পর্কে কিছু বলা দরকার। তারা কাজ করেছে পারিবারিক ইতিহাস নিয়ে। যে কোন বিচারের অর্থনৈতিক, ব্যবসায়িক কিংবা রাজনৈতিক ইতিহাস হতে তা ভিনড়ব। লিঙ্গ এবং শ্রেণীর জটিল আবর্তে থাকা মানুষজনের জীবনচিত্র বুঝতে তাদের দৈনন্দিন আচরণ এবং বিশেষ প্রতিষ্ঠানগুলো দেখা জরুরী মনে করেছে
ওরা। তারা শিল্পশহর বার্মিংহাম এবং কৃষিভিত্তিক কাউন্টি এসেক্স ও সাফককে গবেষণা ক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিয়েছিল। তথ্য সংগ্রহের জন্য তারা ডায়েরী, চিঠিপত্র, পারিবারিক নথি, ব্যবসায়িক নথি, স্থানীয় মানচিত্র, জমির খাজনা বই, কিছু বিয়ের দলিল, উইল, জরিপ, সংবাদপত্রের প্রতিবেদন, স্থানীয় ইতিহাস, সংশ্লিষ্ট বি.এ.,এম.এ.,পি.এইচ.ডি. থিসিস, স্থানীয় সংগঠনগুলোর নথি, স্থানীয় পরিবারগুলোর বংশধরদের সাথে সাক্ষাৎকার এবং জাতীয় পর্যায়ের জীবনী সংগ্রহ ব্যবহার করেছে।
ডেভিডফ ও হলের ভাষান্তরণ ঃ ভাষা, পরিভাষার সংকট
বোধগম্য একটা অনুবাদ কিভাবে সম্ভব ? নৃবিজ্ঞানীর ক্ষেত্রে “বোধগম্যতা”র অর্থ ব্যাপক। ওয়াল্টার বেন্জামিন এ প্রসঙ্গে রুডল্ফ প্যানউইট্জ থেকে উদ্ধৃত করছেন ঃ
“Our translations, even the best ones, proceed from a wrong premise. They want to turn Hindi, Greek, English into German instead of turning German into Hindi, Greek, English. Our translators have a far greater reverence for the usage of their own language than for the spirit of the foreign works. The basic error of the translator is that he preserves the state in which his own language happens to be instead of allowing his language to be powerfully affected by the foreign tongue. Particularly when translating from a language very remote from his own he must go back to the primal elements of language itself and penetrate to the point where work, image and tone converge. He must expand and deepen his language by means of the foreign language.” (দেখুন আসাদ, ১৯৯৩)।১৬
কিন্তু প্যানউইট্জ যা বলছে, সেই অনুযায়ী বিদেশী ভাষা হ’তে নিজ ভাষাকে সমৃদ্ধ করা কোন্ প্রক্রিয়ায় সম্ভব যখন ভাষার অসমতা বাস্তবতা? ভাষা তৈরী এবং প্রবাহিত হওয়াতে ক্ষমতার অসমতা কাজ করে। সেটাই ভাষার অসমতা। দুর্বল সংস্কৃতির ভাষাকে প্রবল সংস্কৃতির চাহিদা এবং ধারণার উপযোগী হ’তে হয়। আসাদ এবং ডিক্সন বলছে, এই শতকে আরবী ভাষা ব্যাপক হারে ইংরেজীর মত করে, উপযোগী হয়ে, বদলে গেছে। আরবীর সাপেক্ষে ইংরেজীর একই রকম রূপান্তরের প্রশ্নই আসে না।১৭ আরবীর ক্ষেত্রে এই যুক্তিটি বাংলা ভাষার বেলায়ও সমানভাবে প্রযোজ্য। ভাষা এবং অনুবাদের ক্ষেত্রে উপযোগীকরণের (accommodation) বিষয়টাই মুখ্য। দেখা দরকার, কোন্ ভাষাকে উপযোগী হ’তে হচ্ছে এবং কোন ভাষাকে হ’তে হচ্ছে না।
অনুবাদের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় আরেকটি বিষয়ও সমান গুরুত্ব রাখে। অচেনা একটা প্রেক্ষিতকে পরিচিতকরণ। অভিধান ঘেঁটে কতগুলো শব্দার্থ বাছাই করে আদৌ কোন “অর্থ” দাঁড় করানো সম্ভব নয়। বিষয়টা নিছক ভাষা বদলের নয়। ডেভিডফ ও হল থেকে রেহনুমার জিজ্ঞাসা ছিল “কোর্টশিপ”-এর বাংলা কি হবে।১৮ দেখা গেল অভিধানে কোন একটা শব্দ
বের করা সম্ভব। কিন্তু বৃটেনের বাস্তবতায় কোর্টশিপের যে “অর্থ” সেটা আমাদের পাঠকরা বুঝবে কিভাবে ? অনুবাদের এই মোকাবিলার মুখোমুখি হ’তে গিয়ে আমরা গদ্যে এক ধরনের সমস্যা এবং কবিতায় আলাদা ধরনের সমস্যায় পড়ি। একটা উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। আঠারো-উনিশ শতকে বৃটিশ পরিবার গঠনে লিঙ্গীয় বিভাজন এবং নানারকম মতাদর্শিক পরিসর নিয়ে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ডেভিডফ ও হল জেমস্ লুককের একটা কবিতাকে উদ্ধতৃ করে। লুকক (১৭৬১-১৮৩৫), একজন ধনাঢ্য শিল্পপতি ছিলেন বার্মিংহামে। যখন তাঁর মনে হ’ল যে বেশিদিন বাঁচবেন না তিনি, তখন তাঁকে স্মরণ করে
তাঁর স্ত্রী মিসেস লুকক (তার স্ত্রীর নাম অজানা) কি ধরনের অনুভ‚তি প্রকাশ করতে পারেন সেই নিয়ে একটা কবিতা লিখলেন তিনি নিজেই। “My Husband” কবিতার অংশবিশেষ ডেভিডফ ও হল ব্যবহার করেছে।
“… Who first inspired my virgin breast,
With tumults not to be expressed,
And gave to life unwonted zest ?
My husband.
Who told me that his gains were small,
But that whatever might befal,
To me he’d gladly yield them all ?
My husband.
Who shun`d the giddy town`s turmoil,
To share with me the garden`s toil,
And joy with labour reconcile ?
My husband.”
Whose arduous struggles long maintain’d
Adversity’s cold hand restrain’d
And competence at length attain’d ?
My husband. … ?
(Davidoff and Hall, Family Fortunes, p. 328)
কবিতাটিকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে হওয়াতে না এড়িয়ে বাংলা করে ফেলা হ’ল।
আমার পতি
কুমারী বক্ষ মোর কে প্রম সজাগিল হায়
μুূ দলনে সে যে অনুভ‚তি প্রকাশ না যায়।
কে (মোর) জীবন ভরে দিল অনভ্যাসী লুব্ধ ইŽছায়
সে যে মোর পতি।
বলেছিল কে আমায় আছে তার কিছুমাত্র ধন
তবু সে যাহা হউক, মোর তরে সে যে সযতন
হাসিমুখে সকলই, সব কিছু করে সমর্পণ
সে যে মোর পতি।
কে পারল শহরের কোলাহল খুব পাশ কেটে
বাগানের কাজগুলো মোর সাথে ভাগ করে খেটে
যুগল কাজের সুখ একসাথে সব নিতে বেটে
সে যে মোর পতি।
কঠিন সংগ্রাম করে চলেছিল বহু দীর্ঘকাল
ভাগ্যের শীতল থাবা শেষমেশ ছেড়েছিল হাল
কার খোলে অবশেষে সাফল্যের সুবিশাল পাল
সে যে মোর পতি।
রেহনুমা ঃ সাম্প্রতিক সময়ে নারীবাদীদের একটি প্রধান যুক্তি হচ্ছে ভাষা নারী-পুরুষের ভিনড়বতা তৈরী করে। ইংরেজীতে যেভাবে করে, বাংলাতে নিশ্চয়ই একই ভাবে করে না।
মানস ঃ হ্যাঁ, আলাদা ভাবেই করে, কিন্তু করে। কিন্তু ভাষার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে তো বলাই হয় যে এটি একটি শ্রেণীবিন্যাস ব্যবস্থা (classificatory system)।
রেহনুমা ঃ শুধুই শ্রেণীবিন্যাস ব্যবস্থা বললেই সমস্যা, ভাষা ভীষণভাবে ঐতিহাসিকও। সেই ঐতিহাসিকতা শ্রেণীবিন্যাসকে শুধু কতকগুলো ক্যাটাগরিতেই সীমাবদ্ধ রাখে না বরং ক্যাটাগরিগুলোর মধ্যকার অসমতা বা স্তরকে তুলে ধরে। যা শুধু ক্ষমতা দিয়েই বোঝা সম্ভব।
মানস ঃ সেই ক্ষমতা সম্পর্ক বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে এক রকম আর ইংরেজীতে অন্যরকম হ’তে পারে।
রেহনুমা ঃ নারী-পুরুষের ভিনড়বতা সেই সাথে অসমতাকে ভাষা এমনভাবে নির্মাণ করে যে লিঙ্গীয় ও যৌন বিষয়ের যাবতীয় ডিসকোর্সগুলোকে২০ অনিবার্যভাবে ‘প্রাকৃতিক’ এবং ‘স্বাভাবিক’ বানিয়ে রাখে।
মানস ঃ ভিনড়বতার ক্ষেত্রে একটা মজার উদাহরণ আপনার কথাতেই আছে। বাংলায় “লিঙ্গীয়” ও “যৌন” দুটো শব্দই কিন্তু এসেছে একেবারেই শারীরবৃত্তীয় শব্দ থেকে। পুরুষ ও নারীর দৈহিক ভিন্নতা এবং প্রত্যঙ্গের নাম হ’তেই এসেছে এগুলো। “লিঙ্গ” এবং “যোনী” শ্রেণীবাচক শব্দ কিন্তু আবার পরিসরের ক্ষেত্রে বিরাট ভিন্নতা অসমতা তৈরী করছে। ব্যুৎপত্তির দিক দিয়ে এ দুটো শব্দই কিন্তু ঐ ধারণা দুটো তৈরী করেছে। তুলনামূলকভাবে “লিঙ্গ” শব্দটি একটু ব্যাপক; স্ত্রী লিঙ্গ কথাটিও বাংলায় ব্যবহৃত হয়, কিন্তু অত্যন্ত
সীমিতভাবে। আর শিব পুজোর ব্যাপার তো আছেই।
রেহনুমা ঃ খুবই দুর্ভাগ্যের ব্যাপার যে শব্দ দুটোই এভাবে এসেছে। কিন্তু এগুলো তো ব্যবহার্য শব্দ নয়, লোকসমাজের ভাষা তো আলাদা। যেমন “নুনু”, “সোনা”। শিক্ষিত সমাজের এ্যাকাডেমিক আলোচনা এবং গণমাধ্যমের ভাষায় “লিঙ্গীয়”, “যৌন” কথাগুলো ব্যবহৃত। এগুলো বিদ্যাজাগতিক বা এ্যাকাডেমিক ডিসকোর্সেই সুসঙ্গত বা পড়যবৎবহঃ.
মানস ঃ সে কারণেই ঐতিহাসিকতার কথা বলেছেন আপনি। একটা নির্দিষ্ট সামাজিক শ্রেণীতে ভাষার অনুশীলন চলে, ভাষা তাই শ্রেণীগত।
রেহনুমা ঃ আপনার কথাতে মনে পড়ছে আশির দশকে যখন আন্তর্জাতিক নারী দশকের কিছু লেখা-জোখা তৈরী করছি আমরা বা ধরুন অনুবাদ, তখন “gender” কথাটির একটা বাংলা প্রত্যয় ভীষণ দরকার হয়ে পড়ল। এর কিছু আগেই পাশ্চাত্যের নারীবাদীরা “ংবী” প্রত্যয়টি থেকে বেরিয়ে আসতে চেষ্টা করছিল। কারণ, সেটাও শারীরবৃত্তীয় এবং সামাজিক অসমতা বোঝানোর জন্য ভিনড়ব কোন প্রত্যয় দরকার।২১ বাংলায় “লিঙ্গ” ধারণাটির সামাজিক পরিসর ব্যাপকভাবে নির্মিত হয় তখন থেকে। এ শব্দ থেকে এখন আর জৈবিক
লিঙ্গকে বোঝার দরকার পড়ে না।
মানস ঃ স্কট যেটাকে রিলেশনাল বলছে। তার ক্ষেত্রে “ফরভভবৎবহঃরধঃরড়হ”-এর ব্যাপারটা স্পষ্ট।২২ “differentiation”-এর ব্যাপারটা আলোচনার দাবীদার। আশির দশকে যখন আপনারা কাজ করেন বাংলা শব্দকে, বাংলা অর্থকে ইংরেজীর সমান্তরাল হ’তে হয়েছে। সেটা আন্তর্জাতিক নারীবাদের প্রেক্ষিতে।
রেহনুমা ঃ অনুবাদের ক্ষেত্রে অচেনা প্রেক্ষিত পরিচিত করানো, যেটা প্যানউইট্জ-এর কথা থেকে আমরা পাই২৩ সেটাই এখানে ঘটেছে। লুককের কবিতাটির ক্ষেত্রে ভাবা যেতে পারে। ধরন কবিতাটির নামই। “Husband”-এর অর্থ বাংলায় “পতি” বা “নাথ”, এমনকি “স্বামী” শব্দতেও ধরা পড়ে না। বাংলায় এই তিনটা শব্দ দিয়েই “প্রভুত্ব” বা “lordship” বোঝায়। পাশ্চাত্যের ইংরেজীভাষী নারীবাদীরা তাদের ধর্মীয় প্রচলনকে প্রশ্ন করে husband” শব্দটিকে গ্রহণ করছে।২৪ গির্জায় বিয়ের শুরুতে নারী-পুরুষকে
“this Man and this Woman”” সম্বোধন করা হচ্ছে; কিন্তু বিয়ের অনুষ্ঠান শেষে বলা হচ্ছে “Man and Wife”। মিলার এবং সুইফ্টের মতে খৃষ্টীয় প্রতীক অনুযায়ী দুজন মিলে এক হ’ল কিন্তু পুরুষের প্রতীকী মর্যাদা অক্ষুণড়ব থাকল আর নারীর মর্যাদা একটি সহযোগী ভূমিকায় রূপান্তরিত হ’ল। সেখানে “husband” ব্যবহার নারীবাদীদের কাছে খৃষ্টীয় “man” এর তুলনায় আরো বেশী গ্রহণযোগ্য। যদিও “husband” “wife”দুটি শব্দ একই ওজনের নয়। ব্যুৎপত্তির দিক থেকে husband শব্দটির স্বতন্ত্র অর্থ আছে, তিনি হচ্ছেন একজন “বিচক্ষণ-ব্যবস্থাপক” যা “Wife” নন।
মানস ঃ অচেনা প্রেক্ষিতের ক্ষেত্রে “my husband” কবিতাটির একটা জায়গা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। “বাগানের কাজগুলো” বাংলাদেশের কোন এক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রী অথবা ছাত্র কিভাবে আঠারো-উনিশ শতকে ইংরেজ মধ্যবিত্ত পরিবারের বাগানের সত্যিকার গুরুত্ব বুঝবে শুধুমাত্র অনুবাদ দিয়ে? তাহলে তো প্রেক্ষিত বা context-এর বিষয় চলে আসেই। ডেভিডফ ও হল বলছে ওই সময়টাতে বাড়ীর বাগান প্রিভেসী ((privecy), নিয়ম, রুচি, প্রকৃতি প্রেম এগুলোর স্মারক হয়ে উঠছে। পুঁজিবাদের বিকাশের
সাথে সাথে বার্মিংহাম শহরের চেহারায় বদল ঘটল। কল-কারখানা, দোকানপাটের মালিকরা সেই শহরে আর থাকতে চাইল না। তারা শহর থেকে দূরে গ্রামাঞ্চলে বাড়ী বানাতে লাগল। সেই বাড়ীতে শহরের বাড়ীর তুলনায় অনেক বেশী জায়গা ছিল। শহর হয়ে দাঁড়াল কাজের জায়গা, শ্রম আর ঘামের জায়গা, নোংরা আর কদর্য জায়গা। বাড়ী হ’ল গৃহ, আশ্রয়; সৌন্দর্য আর শান্তির জায়গা, সুখ আর আরামের জায়গা। ইংল্যান্ডে পুঁজিবাদী বিকাশের সাথে মধ্যবিত্তের কাছে শহর এবং গ্রাম এলাকার বিভাজন অপরিহার্য
হয়ে পড়ল। শহর হ’ল যুক্তিশীলতা, পক্ষান্তরে গ্রাম হ’ল আবেগানুভ‚তি; শহর হ’ল মুনাফার ক্ষেত্র, শহর থেকে দূরে থাকা বাড়ীটি হ’ল ভালবাসা ও মায়াÑমমতার ক্ষেত্র। শহর, কল-কারখানা, দোকানপাট মধ্যবিত্ত ইংরেজের যা কিছু আয়পাত্তি, রাজনীতির জায়গা, তা পাবলিক হয়ে পড়ছে। পৌরুষ (masculinity) সেই পাবলিকের সাথে যুক্ত। বিপরীতে গড়ে উঠছে নারীত্ব (femininity) যা প্রাইভেট। শহর থেকে দূরে থাকা বাড়ী সেই রমনীয়তার পরিচায়ক। বাড়ীতে বাগান চর্চা ঐ সময়ে মধ্যবিত্ত ইংরেজের পরিচয়ের অপরিহার্য দিক। শহরের কোলাহল আর শ্রম পরিবেশে যে শ্রেণী কাজ করতে বাধ্য, তাদের সাথে এই মধ্যবিত্ত শ্রেণীর দূরত্বের স্মারক হচ্ছে বাড়ী। বাগান তখন মধ্যবিত্ত বাড়ীরই পরিবর্ধন।
রেহনুমা ঃ এবং আঠারো শতকের খৃষ্টীয় পুনরুজ্জীবন ( যেমন মেথডিজ্ম, ইভানজেলিকালিজ্ম, কোয়েকার) এক্ষেত্রে অধিক গুরুত্বপূর্ণ; কোন্ পরিবার, কোন্ ব্যক্তি কোন্ গির্জার সদস্য এসব বিষয় এই সময়কালে কেন্দ্রীয় হয়ে দাঁড়াল। সাম্প্রদায়িক আনুগত্য (denominational belonging) ইংরেজ সমাজে গভীর বিরোধ
সৃষ্টি করল, তার ছাপ পরিবারেও পড়ল। তবে মজার ব্যাপার হ’ল যে, সমাজ গঠনে পরিবারের কেন্দ্রীয় ভূমিকা এবং নারী-পুরুষের বিশিষ্ট এবং ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্র এ বিষয়ে কোন সাম্প্রদায়িক ভিন্নতা ছিল না। সকল সম্প্রদায়ই এ ব্যাপারে একমত ছিল। এবং ডেভিডফ ও হলের মতে এ থেকেই তৈরী ইংরেজ নারীদের দ্বন্দ্ব একদিকে, খৃষ্টীয় বিশ্বাস অনুযায়ী সকল আÍা, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে, সমান কিন্তু অপরদিকে, বিয়ের মধ্যে দেখা যাচ্ছে কাঠামোগত অসমতা। অন্য কথায়, ধর্ম আধ্যাতিক সমতার কথা বলে আবার নারীদের সামাজিক এবং যৌন নিপীড়নের পক্ষে।
মানস ঃ অনুভ‚তি কাঠামো তাহলে বিশেষ একটা সমাজে, বিশেষ একটা সময়ে, বিশেষ ঐতিহাসিক বাস্তবতাতেই অর্থবহ। অনুবাদের লক্ষ্যই যদি হয় অনুভূতি-কাঠামো (structure of feelings)’র২৫ সাথে পরিচিত করানো তাহলে কাজটা ঐতিহাসিকও। আসাদ সে কথাই বলেন। অনুবাদ ভাষা, শব্দ, প্রতিশব্দ, পরিভাষা খোঁজার ব্যাপার নয়।
বাংলাদেশের ইতিহাস-লিখন এবং শ্রেণী আধিপত্য২৬ ইতিহাস এবং অনুবাদের সম্পর্ক অত্যন্ত অনিবার্য, আবার সেটাই নৃবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে জোরাল জায়গা তৈরী করছে।
সে কারণেই কতকগুলো জিজ্ঞাসাকে পাশ কাটিয়ে যেতে পারি না আমরা, যে জিজ্ঞাসাগুলো শক্তিশালী পাশ্চাত্যের উপস্থিতি, সেই উপস্থিতিতে গড়ে ওঠা দুর্বল অপাশ্চাত্য, লিঙ্গীয় বিষয়াবলী, অপাশ্চাত্যে লিঙ্গীয় ও শ্রেণীর নির্মাণে পাশ্চাত্যের সংশ্রব
এবং লিঙ্গ ও শ্রেণীর পারস্পরিক অনুপ্রবিষ্টতা বুঝতে জরুরী। জিজ্ঞাসাগুলো : বাংলাদেশের মত প্রান্তিক পুঁজিবাদী দেশে শ্রেণীর গঠন বুঝতে কী ধরনের তাত্তি¡ক কাঠামো প্রয়োজন? ইতিহাস লিখনের কেন্দ্রীয় বিষয় শ্রেণী-আধিপত্য অনুধাবনের
বাইরে সম্ভব কি? যদি সেই দায়িত্ব ইতিহাস-লিখিয়েরা মেনেও নেয়, তাহলেই কি শ্রেণী শুধুই আর্থ-রাজনৈতিক একটা হিসেব-নিকেশের বিষয়? উৎপাদন পদ্ধতি এবং আর্থ-রাজনীতির হিসেব-নিকেশে শক্তিশালী প্রবল মতাদর্শ ধরা যাবে কিভাবে? মতাদর্শের প্রবলতা শ্রেণী গঠন ও শ্রেণী-আধিপত্যের বহির্ভূত বিষয় কি? যদি তা নাই হয় তাহলে মতাদর্শের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত বুদ্ধিজীবীদের শ্রেণী অনুধাবন কাজ করে না কেন? বিশেষ করে লিঙ্গীয় প্রশেড়ব বাংলাদেশের বাম-ডান একাকার হয়ে পড়েন কোন্ প্রক্রিয়ায়? তাদের উভয়ের দৃষ্টিভঙ্গিগুলো কমবেশী উদারনৈতিক (liberalist) কিংবা আধুনিকায়ন
(modernization)ডিসকোর্সের মধ্যে নির্মিত হয় কেন ?২৭ শ্রেণী অনুধাবনের ক্ষেত্রে তাত্তি¡ক বিভ্রান্তিগুলো খুবই মৌলিক, এজন্যে এ প্রশড়বগুলো মোকাবিলা করা দরকার।
প্রচলিত অধ্যয়নে এই বিষয়টাই স্পষ্ট হয় না যে, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে মুসলমান মধ্যবিত্ত হচ্ছে অধিপতি (dominant)শ্রেণী।২৮ মতাদর্শ নিয়ে যখন বড়জোর আলোচনা হয় তখন রাষ্ট্র, জাতীয়তাবাদ প্রেক্ষাপট হিসেবে কাজ করে।২৯ গভীর সামাজিক পরিসরে মতাদর্শ নিয়ে নয়, “মূল্যবোধ” নিয়ে বিক্ষিপ্ত আলোচনা হয়। সেই মূল্যবোধকে আবার দেখা হয় “সনাতনী”, “চিরায়ত” হিসাবে। এভাবে, শ্রেণী ‘সামগ্রিক সামাজিক গঠন’ (total social formation)হিসেবে ধরা পড়ে না। কারণ, শ্রেণী সত্তার ওতপ্রোত বিষয় যেমন আর্থনীতিক, রাজনৈতিক, তেমনি বুদ্ধিবৃত্তিক, মতাদর্শগত। প্রচলিত অধ্যয়নে কালμমে অন্ততঃ দুটো স্পষ্ট গোলমাল তৈরী হয়। প্রমত, শক্তিশালী শ্রেণী বলতে সবচেয়ে বেশী সম্পদের মালিক
তথাকথিত বুর্জোয়া বোঝান হয় শিল্পবিপ্লব না হওয়ার কারণে এবং ঔপনিবেশিক প্রভাবের কারণে ইউরোপীয় আদলের সে বুর্জোয়া আদৌ নেই এখানে। দ্বিতীয়ত, ইতিহাস-লিখিয়েরা যেভাবে ঘটনা সাজায় তাতে ঘুরে ফিরে আধুনিকায়ন ধারা চলে আসে। লিঙ্গীয় বিষয়ে আলোচনায় সে ব্যাপারটা আরো প্রকট হয়ে ওঠে। যেমন ব্রাহ্ম সমাজ, সেই সাথে রাজা
রামমোহন রায় দুই বাংলাতেই ইতিহাসবেত্তাদের বিশ্লেষণ একই রকম গুরুত্ব পান নারী প্রসঙ্গ আলোচনার ক্ষেত্রে। বাংলাদেশ এবং পশ্চিম বাংলায় শ্রেণী গঠনের ঐতিহাসিক বাস্তবতা এবং রূপ যে ভিন্ন সে সত্য ধুয়ে মুছে যায়। “ভদ্রলোক” শ্রেণী গঠনের ইতিহাসকেই বাঙ্গালী মুসলমান মধ্যবিত্ত শ্রেণী গঠনের সমরূপ ধরে নেয়া হয়। অথচ ভদ্রলোক সত্তা নির্মাণের ক্ষেত্রে মুসলমান ছিল “অন্য”, “চাষাভুষা”, “গোঁড়া”, “অনালোকিত”।
রামমোহন হতে শুরু করার মধ্য দিয়ে ইতিহাস-লিখনে প্রতিষ্ঠিত হয় শিক্ষিত হওয়া, অন্দরমহল থেকে বেরিয়ে আসা নারী মুক্তির উপায়। রাষ্ট্রের ভূমিকা, অনিবার্যভাবেই রামমোহনের সময় ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র, সেখানে পৃষ্ঠপোষকের কিংবা উদারতা চর্চাকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে মহত্তর। হাল আমলেও নারী মুক্তির প্রশড়বটি শিক্ষা এবং রাষ্ট্রীয়
পৃষ্ঠপোষকতার সাথে যুক্ত করে দেখা হয় যে কারণে সব সময়ই মনে হতে পারে একটা সুষম সমতার যাত্রা পথে নারী রয়েছে। আধুনিকায়ন দৃষ্টিভঙ্গি এই ধারণা নির্মাণ করে। রামমোহন একটা উদাহরণ মাত্র। যে কথাটা স্পষ্ট করা দরকার তা হ’ল তৎকালীন সময়ে রামমোহনের কাজ নিয়ে এই সময়ের ইতিহাস-লিখিয়েরা উদারনৈতিক পরিকাঠামোতেই
(framework)বিশ্লেষণ করে। এই বিশে- ষণ কাঠামো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নীরব শ্রেণীগঠন, মধ্যবিত্ত আধিপত্য এবং এই নীরবতার মধ্য দিয়ে এই শতকের বাঙ্গালী মুসলমান সমাজে, শিক্ষিত সমাজে, অসমতা এবং বৈষম্যের মৌলিক পুনর্গঠনকে অদৃশ্য করে ফেলে। আধুনিকীকরণ তত্ত্বের সাথে এর সংযোগ হচ্ছে যে, এই বিশ্লেষণ কাঠামো আধুনিক
ক্ষমতা কিভাবে অসমতাকে পুনর্নির্মাণ করে তা “সনাতন”, “পুরাতন” “কুসংস্কার” এই সকল ধারণা দিয়ে ঢেকে দেয়।
৩. পাশ্চাত্যের অন্য এবং সাংস্কৃতিক হেজেমনি : বাঙ্গালী মুসলমান মধ্যবিত্ত
অনুবাদযোগ্য ঐতিহাসিক কাঠামো : এক স্বামী-স্ত্রী বিয়ে ও পরিবর্তিত যৌন মনস্কতা
আসাদ অনুবাদের ক্ষেত্রে একদম নতুন দিক নির্দেশনা তৈরী করেছে। যা সাহিত্যের এবং ভাষান্তর তাত্ত্বিকদের (translation theorists) থেকে একদম ভিন্ন। তার বিবেচনায় অনুবাদ ভাষা বা সাহিত্যের বিষয় নয়, ঐতিহাসিক কাঠামোর বিষয়।৩০ তার কাজে ‘অনুবাদ’ এর ধারণা পাশ্চাত্য এবং অপাশ্চাত্য সমাজের মধ্যকার ক্ষমতা-সম্পর্ক বুঝবার জন্য জরুরী। এই ক্ষমতা ঐতিহাসিক। পশ্চিমা ধ্যান ধারণা এবং অনুশীলন আইন, ব্যাঙ্ক ও বীমা, শিক্ষা, পুলিশী ব্যবস্থা এগুলো অপশ্চিমা সমাজে অনুবাদযোগ্য। এবং একটা ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায় অনূদিতও । অনুবাদের এই কাজ ধারাবাহিক একটা প্রক্রিয়া।
একটা সমাজে উপনিবেশবাদ, অনিবার্যভাবেই সেটা অপাশ্চাত্য সমাজ, ভাষা, চিন্তা কাঠামো, অর্থপূর্ণতার বদল ঘটায় যা সমাজ কাঠামো, আচার-আচরণ পুনর্গঠিত করে। তার মধ্যে স্থানীয় যেমন বাঙ্গালী ঐতিহ্যও সংমিশ্রিত হয়ে যাচ্ছে। এই সংমিশ্রিত সত্তা আবার ভীষণ ক্ষমতাবান। এই পুনর্গঠন যান্ত্রিক নয়, ঘটে অপাশ্চাত্যের মানুষজনের কার্যকারিতা
দ্বারাই; এবং সকল ক্ষেত্রে সমানভাবে ঘটেও না। উপনিবেশবাদের প্রেক্ষিতে কোন অঞ্চলের ভাষা, চিন্তাকাঠামো বদলের ক্ষেত্রে আসাদ এবং ডিক্সন৩১ লিয়েনহার্টের
কাজ থেকে ডিংকাদের উদাহরণ দেয়। ডিংকাদের ভেতরে “লো তোয়েং” বললে বোঝাত ‘অগ্রবর্তী’ যা বয়স এবং অভিজ্ঞতার সাথে যুক্ত ছিল। তরুণ প্রজন্ম বয়স্ক প্রজন্মের পর্যায়ে আসবে এটাই স্বাভাবিক ছিল। ঔপনিবেশিক সময়ে বয়স, অভিজ্ঞতার ধারণাগুলো সরিয়ে দিয়ে শব্দটাকে দখল করল ‘প্রগতি’র ধারণা। তখন থেকে “লো তোয়েং” ডিংকাদের মধ্যে
প্রগতি বোঝায়, দুনিয়াতে এগিয়ে যাওয়া বোঝায়। পশ্চিমা এই ধারণার অনুপ্রবেশ, অপশ্চিমা দুর্বল একটা সমাজে সম্ভব হয়েছিল, পশ্চিমের কাছে তা কাম্যও ছিল, ঔপনিবেশিক শক্তির কারণে। ঔপনিবেশিক শক্তিকে বাদ দিয়ে, আর ক্ষমতাসম্পর্কের ইতিহাস বাদ দিয়ে এই রূপান্তর বোঝা সম্ভব নয়।
এখন প্রশ্ন হল, পশ্চিমা ধ্যান-ধারণা এবং অনুশীলন অনুবাদের ক্ষেত্রে অপাশ্চাত্যের মানুষজনের ভ‚মিকা কী ? শ্রেণী গঠনের প্রসঙ্গে গ্রামসীর যে বিশ্লেষণ তাতে যৌগ (organic) বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তার বিশেষণে এদের ভূমিকা মতাদর্শ তৈরী করে, বিস্ততৃ করে এবং সংবহিত করে। শ্রেণী গঠনের এই বিষয়টা পুঁজিবাদী
বিকাশের সাথে সাথেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঘটে না। এমনকি সম্পদ, অর্থ শুধুমাত্র এসবের হিসেবে শক্তিশালী অধিপতি শ্রেণীকে চিহ্নিত করাও সম্ভব নয়। সেইটাই গ্রামসীর যুক্তি। গ্রামসীর বিশে- ষণকে ডেভিডফ ও হল ব্যবহার করেছে আঠারো ও উনিশ শতকের বৃিটিশ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর গঠন বুঝতে। লিঙ্গীয় মতাদর্শ কোনও ভাবেই শ্রেণী গঠনের বহির্ভত‚ বিষয় নয়। অন্যভাবে বললে শ্রেণী পরিচয়ের অনিবার্য দিক লিঙ্গীয়। তৎকালীন, বৃটিশ সমাজে মধ্যবিত্ত গঠনের বেলায় অগ্রণী বুদ্ধিজীবীরা (কবি, সাহিত্যিক ইত্যাদি) লিঙ্গীয় ভিন্নতাকে বিধিবদ্ধ করছে তাদের লেখাতে, যাদের কথা ডেভিডফ ও হল উদ্ধৃত করছে।
বড় মাপের লেখক যেমন উইলিয়াম কাউপার, হানাহ্ মোর বিধিবদ্ধের কাজ করছে আর অজস্র মফস্বলী লেখক পুস্তিকা (pamphlet),, কবিতা, দৈনিক পত্রিকার লেখালেখি, গির্জার পত্রিকায় লেখার মাধ্যমে সক্রিয়ভাবে এই বিধিবলীকে অনুবাদ করছে, এর ব্যাখ্যা দিচ্ছে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিমূর্ত (abstract)) ধারণাগুলোকে মা হিসেবে, বাবা হিসেবে,
পুরোহিত হিসেবে, ডাক্তার হিসেবে তাদের দৈনন্দিন জীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে অনুবাদ করছে এরা। এই মফস্বলী লেখকদের অধিকাংশই জাতীয় পর্যায়ে অপরিচিত থেকে গেছে, তারা বড়সরো বুদ্ধিজীবী নয়, কিন্তু মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ভূমিকা পালনের কারণে, তাদের ডেভিডফ ও হল যৌগ বুদ্ধিজীবী ডাকছে। বার্মিংহামের এই বুদ্ধিজীবীরা তাদের লেখনীর মাধ্যমে ‘পৌরুষ’ এবং ‘নারীত্ব’কে নির্মাণ করছে, গৃহীপনার মতাদর্শকে গৃহস্থালী পর্যায়ে, পারিবারিক পর্যায়ে বাস্তব রূপ দিচ্ছে, বিমূর্ত জ্ঞানকে সাধারণ বুদ্ধিতে পরিণত করছে। সাধারণ বুদ্ধির ব্যাপারটা আবার সাধারণ নয়, ক্ষমতা-সম্পর্কের
সাথে যুক্ত। গ্রামসীর চিন্তাতে সহজেই ধরা পড়ে যে, প্রবল শ্রেণীর আধিপত্য মতাদর্শিক আধিপত্য, সাধারণ বুদ্ধিতে প্রকাশিত হয়।
বাঙ্গালী মুসলমান মধ্যবিত্তের গঠন এবং এই সমাজের রূপান্তর বুঝবার ক্ষেত্রে পাশ্চাত্যের প্রবল উপস্থিতি, পাশ্চাত্য-অপাশ্চাত্যের ক্ষমতা সম্পর্ক এবং সেই ক্ষমতা সম্পর্কে স্থানীয় কার্যকারিতা (agency) সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ঊনিশ শতকের শেষভাগ এবং বিশ শতকের প্রম ভাগে বাঙ্গালী মুসলমান মধ্যবিত্ত গঠনের সূচনা; শ্রেণী গঠনের সাথে শুরু
হয় পরিবার, বিয়ে ব্যবস্থা এবং নারী পুরুষের সম্পর্কে আমূল পরিবর্তনের প্রক্রিয়া। ঊনিশ শতকে অনুশীলিত বহুবিধ বিয়ে পুনর্গঠিত হয় এক স্বামী-স্ত্রী বিয়েতে, এবং এই শতকে তা প্রকাশিত হয়েছে নৈতিকতা, সমতা এবং প্রগতিশীলতার স্মারক হিসেবে। এক স্বামী-স্ত্রী বিয়ে যে একমাত্র নৈতিক বিয়ের ধরন, মধ্যবিত্তের বেলায় খুবই অল্প সময়ে, ৪০-৫০ বছরে, সেটা সাধারণ বুদ্ধিতে পরিণত হয়েছে। এই সাধারণ বুদ্ধির অনুশীলন এই শ্রেণীতেই সম্ভব, এবং এই শ্রেণীর পরিচয়ের অবিচ্ছেদ্য দিক। শ্রমিক শ্রেণী এবং খুব গরীবদের বিয়ে ব্যবস্থাকে মধ্যবিত্ত তাদের উচ্চতর নৈতিক অবস্থান থেকে বিচার করে ; তাদের
বিয়ের কোন ঠিক ঠিকানা নেই বলে আক্ষেপ করে। এই আক্ষেপ নীতিনৈতিকতা চর্চার অংশ, এবং আমাদের যুক্তি হ’ল, শ্রেণী আধিপত্যের সাথে যুক্ত। প্রশড়ব হ’ল, কোন্ বিশেষ ঐতিহাসিক মুহূর্তে এক স্বামী-স্ত্রী বিয়ে এবং এর সাথে যুক্ত বিশেষ ধরনের যৌন মনস্কতা সাধারণ বুদ্ধি হয়ে দাঁড়াল, আধিপত্য লাভ করল? কিভাবে মধ্যবিত্ত চৈতন্যের গুরুত্বপূর্ণ দিক হয়ে দাঁড়ায় তা? বৃহত্তর অর্থনৈতিক ও মতাদর্শিক রূপান্তর যা ঔপনিবেশিক আমলে ঘটল তার বাইরে কি এই বিয়ে, পরিবার ব্যবস্থা, নারী পুরুষের আদর্শ সম্পর্ক বোঝা সম্ভব? এই রূপান্তর কি পাশ্চাত্যের হেজেমনির বাইরে বোঝা সম্ভব?
ঊনিশ শতকের শেষভাগে মধ্যবিত্ত গঠনের আগে বাঙ্গালী মুসলমানদের মধ্যে একাধিক বিয়ে সব শ্রেণীতেই স্বাভাবিক ধরে নেয়া হতো। গ্রামের জমিদার শ্রেণী কিংবা প্রজা শ্রেণী অথবা গেরস্ত কোথাওই অগ্রহণযোগ্য নয় তা। সৈয়দা মনোয়ারা খাতুনের (১৯০৯-১৯৮১) লেখায়৩২ পাই তাদের গ্রামের এক চাষী প্রজার তিন বউ ছিল। জমিদার শ্রেণীতেও একই
নজির মিলছে। জমিদার পরিবারের সদস্য মনোয়ারা খাতুন। তার বড় বোনের শ্বশুর তারাও জমিদার পঞ্চমবারের মত বিয়ে করেছিলেন। একদিকে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র কাঠামোতে ছোটখাট চাকরীর মধ্য দিয়ে শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর গোড়াপত্তন হচ্ছে, একই সাথে একাধিক বিয়ের প্রচলন তখনও এ সকল মানুষজনের পারিবারিক জীবনে বাস্তব ছিল। আখতার ইমামের (জন্ম ১৯১৭) লেখাতেও পাই তার দাদার বান্দী-বউ ছিল।৩৩ একাধিক বিয়ের উপস্থিতি পাই দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের (১৯০৬-১৯৯৬) আত্মজীবনীতে ৩৪, কামরুদ্দীন আহমেদ (১৯১৩-১৯৮২)৩৫ এবং আরও অনেক নব্য-গঠমান মধ্যবিত্ত,
শিক্ষিত নারী পুরুষের লেখনীতে।
জমিদার নবাবদের বেলায় বিবাহিত স্ত্রী ছাড়াও বান্দী বউ বা তরফ্সানী৩৬ ছিল। প্রজাদের বা গেরস্তদের বেলায় বান্দী-বউয়ের প্রশড়বই আসে না, যদিও একাধিক বিয়ের রেওয়াজ ছিল। একথা সত্য যে, নারীর ক্ষেত্রে অবস্থাটা ভিনড়ব। এক স্বামীরই ঘর করত তারা কিন্তু একাধিকবার বিয়ে সম্ভব ছিল। তাহলে পুরুষের বেলায় একগামী বিয়ে, একাধিকবার একগামী বিয়ে, বহুগামী বিয়ে, বান্দী বিয়ের চল ছিল। এতেই অবশ্য পুরুষের সমস্ত যৌন অনুশীলন ধরা পড়ে না। জমিদারসওদাগরদের নগরের বেশ্যালয়ে যাতায়াত ছিল কিংবা তারা দাসীদের যৌন নির্যাতন করত৩৭। জমিদার ও গেরস্ত ঘরের নারীদের বেলায় একাধিকবার একগামী বিয়ে বিধিসম্মত ছিল। যদিও জমিদার ঘরের কন্যাদের একাধিকবার বিয়ের ঘটনা কম জানা যায়। সার্বিকভাবে, পুরুষদের তুলনায় একাধিকবার একগামী বিয়ে (serial monogamy)) নারীর কম হতো। কিন্তু বলা যায়, সামগ্রিকভাবে বিয়ে ব্যবস্থা ছিল বহুবিধ।
দুয়েক প্রজন্মের মধ্যেই বাঙ্গালী মুসলমান মধ্যবিত্তের স্মারক হয়ে উঠল পরিবর্তিত বিয়ে ব্যবস্থা। অন্যান্য ধরন মুছে ফেলে এক স্বামী-স্ত্রী বিয়ে একমাত্র গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে। কতকগুলো বিষয় পরপর ঘটছিলঃ সাম্প্রদায়িক প্রতিনিধিত্বের রাজনীতির মধ্যে একটা সমরূপ, অবিভাজিত ‘মুসলিম’ জাতি সৃষ্ট হয়। মুসলিম জাতির নেতৃত্বের দাবীদার হয়ে উঠল এই নব্য-গঠমান মধ্যবিত্ত; পুরাতন জমিদার ও নবাবেরা বারংবার চিহ্নিত হল ‘নীতিহীন’ এবং ‘অধঃপতিত’ গোষ্ঠী হিসেবে। সাহিত্য, নাটক, পত্র-পত্রিকায় জমিদারদের জীবনযাপন, পরিবার ব্যবস্থা, মূল্যবোধ নিয়ে কটাক্ষ তৈরী হল। মধ্যবিত্তের নেতৃত্ব দাবী করবার মৌলিক ভিত্তি ছিল প্রমত ঃ শিক্ষা, দ্বিতীয়ত ঃ গৃহস্থালী পরিমার্জনা বা নতুন বিয়ে এবং যৌন আচরণবিধি।
আমাদের যুক্তি হল, এই দুটো বিষয়ই অর্থাৎ আধুনিক শিক্ষা এবং বিয়ে ও যৌন আচরণবিধি পশ্চিমা প্রকল্পের অংশ। কিন্তু এ কথার অর্থ এই নয় যে, গোটা ব্যাপারটাই পশ্চিমা ষড়যন্ত্র। আমরা দেখতে পাচ্ছি, পশ্চিমা প্রকল্পের অন্ততঃ দুটো স্পষ্ট দিক যা আবার গভীরভাবে সম্পর্কিত। একটা অবশ্যই আর্থব্যবস্থার পুঁজিবাদী রূপান্তর; দ্বিতীয়টা মতাদর্শিক।
তার মধ্যে শিক্ষার রূপান্তর সহজেই চিহ্নিত করা যায়। চিহ্নিত করা হয় না বিয়ে ও যৌন ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে প্রকল্পের স্বরূপকে। এটাও আমাদের যুক্তি যে, আর্থব্যবস্থা ও মতাদর্শের যুগপৎ রূপান্তরই ঘটেছিল, নইলে পশ্চিমা প্রকল্প ব্যহত হ’ত। বাস্তবে যাই ঘটুক না কেন, এই শতকের পঞ্চাশের দশকের মধ্যেই যৌন অনুশীলন (sexual practice),
যৌন মনস্কতা (sexual attitudes) বিয়ের সাথে শর্তযুক্ত হয়ে পড়ল। বিয়ের পরিসীমাতেই যৌনতা সম্ভব বলে মনে করা হল। মধ্যবিত্ত পরিচয় নির্মাণে ভীষণ জরুরী এটি। এক স্বামী-স্ত্রী বিয়ে নৈতিক উৎকর্ষের ব্যাপার হয়ে পড়তে দেখা যায়। মধ্যবিত্ত চৈতন্য (consciousness) নির্মিত হয় এভাবেই। রূপান্তরের এই প্রক্রিয়াটি নিছক আপনা-আপনি ছিল না। যৌগ (organic) বুদ্ধিজীবীদের ভ‚মিকা ছিল, যে কথা আগেই বলেছি। তেমনি রাজনৈতিক নেতৃত্বেও “নৈতিক” নেতৃত্ব দানকারীরা জায়গা করে নিচ্ছিল।
এক স্বামী-স্ত্রী বিয়ে যে উৎকৃষ্ট, নৈতিক, আদর্শিক সেটা প্রগতির ধারণার সাথে যুক্ত। সেটা স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে যখন এই বিয়ে ব্যবস্থাকে দেখা হয় নারী-পুরুষের সমতাবিধানকারী হিসেবে। এই সমতা দিয়েই প্রগতির ধারণাটা চিনতে পারি আমরা। প্রগতির পুরো ডিসকোর্সই পাশ্চাত্য হেজেমনির বিষয়। দেখা দরকার, বুর্জোয়া সমতার যে অন্তঃবৈরীতা
(dilemma) তা এক স্বামী-স্ত্রী বিয়ের মধ্যেও কিভাবে কাজ করে। আধুনিক বিয়ে যে অসম, স্বামী যে বহুভাবে ক্ষমতাশালী এবং কর্তৃত্ববান (আর্থিক, মতাদর্শিক, আইনগত) ঢাকা পড়ে পাশ্চাত্যের শক্তিমান একগামী বিয়ের মতাদর্শ এবং প্রত্যাশিত দাম্পত্যপনার মধ্য দিয়ে।
দাম্পত্যপনার মতাদর্শ নব্যগঠিত গৃহীপনার মতাদর্শের অংশ। নারী এই পরিকাঠামোতে ঘরণী, তার ভ‚মিকা নৈতিক, আদর্শিক। নারী চৈতন্যের বিশাল জায়গা জুড়ে আমরা দেখতে পাই যৌন শুচিতা (sexual purity) । পুরুষের পরিচিতি এই পরিকাঠামোতে আর্থিক। তার কাজের জায়গা বহির্জাগতিক (রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক) ; তার
শুচিতার ব্যাপার নারীর মত সংকটের নয়। ঘর-বাহির (পাবলিক-প্রাইভেট) পুনর্গঠনের মধ্যে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কাছে সম্মানবোধ আর চরিত্র ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াল। সেই চরিত্র চর্চার কেন্দ্রীয় জায়গা, মুখ্য জায়গা নারী। নারীর শুচিতার নতুন নতুন উপাদান তৈরী হয় এই সময়ে। পূর্বতন সময়কাল হ’তে তা ভিনড়ব। নারীর শুচিতা রমনীয় পরিচয় ও নারী চৈতন্যের অনিবার্য দিক হিসেবে গড়ে তোলা হয়; নানাবিধ প্রাতিষ্ঠানিক (স্কুল, কলেজ ইত্যাদি) বিধিনিষেধ এই শতকের গোড়া থেকে স্থাপিত হয় যার লক্ষ্যই ছিল নারী শুচিতা পাহারা দেয়া। এই ধরনের নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয়েছিল বিয়ে ব্যবস্থা ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে
উঠবার মধ্য দিয়ে। পুরুষের আর্থিক ভূমিকা এক স্বামী-স্ত্রী বিয়ের ক্ষেত্রে এত প্রকট, যা বিশ শতকের মজুরী অর্থনীতিতে বাঙ্গালী মুসলমানের অংশগ্রহণের আগে ছিল না, যে চাকরী পাওয়ার সাথে “বউ পালতে” পারার সামর্থ্য জড়িত হয়ে পড়ল।
পৌরুষের ধারণার ভিত্তিই হচ্ছে স্বাধীন রোজগার, নির্ভরশীল বউ-বাচ্চার লালন-পালন। বটবৃক্ষ এই পুরুষ ইমেজ কিন্তু যৌতুককে বুঝতে সাহায্য করে না। অথচ যৌতুকের ইতিহাস ছাড়া বাঙ্গালী মুসলমান মধ্যবিত্তের গঠন বোঝাই সম্ভব নয়। কনে পণপ্রথা হতে যৌতুকে রূপান্তর এই শ্রেণীর গঠনের সাথে সম্পর্কিত বিষয়। প্রম প্রজন্মের পুরুষরা জায়গীর থেকে সেই বাড়ীর কন্যাকে বিয়ে করেছে। সেটা আর্থিকভাবে সুবিধেজনক ছিল। এমন নজির প্রচুর। আরো দেখা যায়, শ্বশুরের টাকায় লেখাপড়া চালিয়ে গেছে, উচ্চ শিক্ষিত হয়েছে। বর্তমান সময়ে মধ্যবিত্তের মধ্যে যৌতুক হচ্ছে ঘর ও মেয়ে সাজিয়ে
দেয়া। মধ্যবিত্ত জীবনযাপনে যা কিছু আরাম আয়েশের উপকরণ তা বিয়ের শর্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়াও পরিবারে রোজগারী পুরুষদের ভেতরে আয়ের ভিত্তিতে বৈষম্য দেখা দিল। যে ভাই বেশি রোজগার করছে সে “কর্মঠ”, “উদ্যমী”, অল্প রোজগারী ভাই “অলস”, “অকর্মণ্য”। পুঁজিবাদী মতাদর্শে মজুরী ব্যক্তিগত অর্জন। যে আয় করে সে তার ইচ্ছেমাফিক তার বউ ও বাচ্চাদের লালন-পালনের জন্য খরচ করতে পারে। এটা ঘটার পাশাপাশি যৌথ পরিবারগুলোর মধ্যে দম্পত্তিভিত্তিক মনস্কতা তৈরী হচ্ছে যার কেন্দ্রে একজন রোজগারী পুরুষ থাকছে। হিন্দু “ভদ্রলোক” শ্রেণীর মধ্যে যেটা কয়েক দশক আগে আরম্ভ হয়েছিল,৩৮ বাঙ্গালী মুসলমানদের ক্ষেত্রে সেটার শুরু এই শতকের বিশ
তিরিশের দশকে।
গৃহীপনার মতাদর্শের দাম্পত্যপনা এবং যৌন মনস্কতা ওতোপ্রোতভাবে যুক্ত। দাম্পত্যপনা ক্রমশ প্রত্যাশিত হিসেবে দেখা দিল। বিয়ের মাধ্যমে যৌন অনুশীলনের যাবতীয় সীমারেখা টেনে স্পষ্ট করা হল কোন্ ধরনের অনুশীলন কাম্য নয়, কী “বৈধ” এবং কী “অবৈধ”। বিয়ের সীমার বাইরে সবকিছু অবৈধ হয়ে পড়ে আর বিয়েই একমাত্র ‘বৈধকারী’ ব্যবস্থা
হিসেবে চিহ্নিত হয়। বিয়ে, অবশ্যই একগামী বিয়ে, একমাত্র স্বাভাবিক হয়ে পড়ল; ‘বিয়ে’ হীন অবস্থা তাই অস্বাভাবিক। নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি হতে জিজ্ঞাসা হচ্ছে, যদি বিয়েই একমাত্র বৈধকারী ব্যবস্থা হয় এবং তা স্পষ্টতই শ্রেণী আধিপত্যের সাথে যুক্ত, তাহলে বিয়ের মধ্যে নারীর যৌন নির্যাতন বা ংবীঁধষ ারড়ষবহপব ধরা পড়বে কিভাবে? এক প্রজন্মের মধ্যে
মতাদর্শের এ রকম শক্তপোক্ত পরিসীমা ধরা পড়ে দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের আত্মজীবনীতে। একাধিক বিয়ে করার হাত থেকে তিনি পরিত্রাণ পেয়েছিলেন তাঁর ভাষায় “জীবন আদর্শের বলিষ্ঠতার জন্যই”।৩৯ এই আদর্শ একই সাথে প্রগতির ধারণার সাথে যুক্ত এবং মধ্যবিত্ত আধিপত্যের ক্ষেত্রে নির্ধারক হিসেবে কাজ করে। গৃহীপনার মতাদর্শকে আমরা দেখতে পাই মধ্যবিত্ত সত্তার প্রধানতম দিক হিসেবে যা এই শ্রেণীর আধিপত্য নির্মাণে মতাদর্শিক ভ‚মিকা রেখেছে। বিয়ে, অবশ্যই এক স্বামী-স্ত্রী বিয়ে, যৌন মনস্কতা এবং দাম্পত্যপনার রূপরেখা তৈরী করে আর সব কিছুকে “অন্য” এবং “অবৈধ” নির্মাণ
করেছে। নৈতিক উৎকর্ষের জায়গা থেকে মধ্যবিত্ত অনায়াসেই নিæ শ্রেণীর বিয়েকে “ভঙ্গুর”, তাই “চরিত্রহীন” এবং “অসভ্য” বলতে পারে। পক্ষান্তরে, মধ্যবিত্ত অনুশীলনই “প্রগতিশীল”, “রুচিসম্মত”। মধ্যবিত্তই মানদণ্ড তৈরী করে।৪০ প্রগতির ডিসকোর্সেই মধ্যবিত্তের এই রূপান্তরকে বোঝা সম্ভব, অন্তর্নিহিত প্রগতির তাগিদেই মধ্যবিত্ত মতাদর্শ
গঠিত এ থেকে স্পষ্ট করে পাশ্চাত্যের সাংস্কৃতিক হেজেমনিকে দেখতে পাই আমরা।
নতুন ধরনের ভাষা এবং নতুন আচরণের সম্ভাবনা শহুরে মধ্যবিত্তদের দৈনন্দিন আলাপচারিতায় “সংসার” কথাটির উপস্থিতি ব্যাপক। সংসার বলতে গৃহস্থালী বোঝায়,
কিন্তু সেই গৃহ দাম্পত্যপনার সাথে যুক্ত। মধ্যবিত্ত চৈতন্যে সংসার ঘর হতে আলাদা নয়।৪১ বলা হয় “ঘর-সংসার”। এই ঘর, অন্য ভাষায় গৃহ- গৃহীপনার মতাদর্শ দিয়েই চেনা সম্ভব। বিযুক্ত করে ইট-দেয়ালের একটা কাঠামোকে ঘর হিসেবে দেখা হয় না। এবং অনিবার্যভাবেই এই ঘর, গৃহ নির্মিত হয় এক স্বামী-স্ত্রী বিয়ের মধ্য দিয়েই। অন্য কোন পরিসর ভাবাই যায় না মধ্যবিত্ত চৈতন্যে। সংসারের ভিত্তিই হচ্ছে লিঙ্গীয় ভিনড়বতা। “সংসার চালানো” এবং “সংসার করা” পুরুষ এবং নারীর জন্য ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকা। আগেই যেমনটা বলেছি, সংসার চালানোর ভ‚মিকা অর্থনৈতিক, সংসার করা আদর্শিক, নৈতিক। সংসারের ধারণা এতটাই নৈতিক, এত মূল্যবোধ আরোপিত যে গৃহশ্রম (domestic labour) এবং গৃহিণীর নানান কাজ ঢাকা পড়ে যায় এর মধ্যে। এই কাজগুলো নানাবিধ যেমন- রানড়বা, ঘর ঝাড়ূ-মোছা, কাপড় ধোওয়া, বাচ্চাদের পালনের কাজ এবং
প্রতিমুহূর্তের তদারকী, স্বামীর আরাম-আয়েশের ব্যবস্থা, শ্বশুরবাড়ীর লোকদের সেবাযত্ন করা, আত্মীয়-স্বজনদের সাথে যোগাযোগ রাখা। যদিও অধিকাংশ শহরে মধ্যবিত্তের ভারী কাজগুলো চাকররা করে কিন্তু, গৃহের সার্বিক ব্যবস্থাপনার গুরুদায়িত্ব গৃহিণীরই।
“সংসার” শব্দটা যে ধারণাগুলোর সমন্বয়ে গঠিত এই শ্রেণীতে এই সময়ে, সেটা রূপান্তরিত একটা অবস্থা। যদিও লিখিত তথ্যাদি কম যা ঐতিহাসিক অনুসন্ধানকে ব্যাহত করে, তবুও একথা বলা সম্ভব যে, উনিশ শতকেও সংসারের এ রকম ধারণা ছিল না। সংসার চালানো নয়, পুরুষ সংসার করত। কৃষ্টি গৃহস্থালীতে নারী ও পুরুষের উভয়েরই সংসারের
কাজ ছিল ভিন্ন ভিন্ন ও নির্দিষ্ট। শহরে চাকুরিজীবী পরিবারে, মজুরী অর্থনীতির বিকাশে সংসার করা কেবলই নারীর অস্তিত্বের পরিচায়ক হয়ে দাঁড়ায়। এই রূপান্তরণের বিষয়টা ডিংকাদের “লো তোয়েং”-এর সাথে তুলনীয়। পাশ্চাত্যের সাংস্কৃতিক হেজেমনির ধারণা ছাড়া এই রূপান্তর কিভাবে বোঝা সম্ভব ?
প্রগতি এবং উদারতার ডিসকোর্সেই এই রূপান্তর সম্ভব হয়েছে। আমাদের মতে, আগেই বলেছি, এইগুলো পশ্চিমা প্রকল্পেরই অংশ। রূপান্তরের ফলে নতুন ভাষা কিংবা ভাষার নতুন অর্থ তৈরী হচ্ছে তাই শুধু নয় বরং নতুন আচরণ নির্মিত হচ্ছে; সেটা মতাদর্শের কারণে। “সংসার” উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করেছি, অন্য দু একটা উদাহরণ আলোচনা করা যেতে পারে। মধ্যবিত্তরা “স্বামী” বা “স্ত্রী” বা “পরিবার” ব্যবহার করে না সচরাচর। তাদের ভাষায় এগুলো প্রায়শই ““husband”, “wife”, “family”ইত্যাদি। এটা শুধু এই কারণে নয় যে ইংরেজী চর্চা বাড়ছে। স্বামী বা স্ত্রী কিংবা husband, wife শব্দগুলোই পয়দা হ’ল এই শতকে। “বাচ্চার মা”, “উনি” এগুলো মধ্যবিত্ত ব্যবহার করে না। এক স্বামী-স্ত্রী
বিয়েতে যে “দুজনে দুজনার” মডেলের কথা বলা হয় সেটার নতুন শব্দ দরকার ছিল। husband, wife” নতুন ভাষা হিসেবে রূপান্তরিত বিয়ে ব্যবস্থার আচরণকে ধারণ করে। প্রসঙ্গত, আগেই বলেছি, স্বামীর জায়গায় যঁংনধহফ বললেই এই বিয়ে ও পরিবারে পুরুষের ক্ষমতা উধাও হয়ে যায় না। অন্য একটা উদাহরণও মজার হতে পারে। সাধারণত “আয়োজিত বিয়ে”(arranged marriage) এবং “প্রেমের বিয়ের” ভেতরে একটা বৈরীতা দেখানো হয় আয়োজিত বিয়ে সনাতনী, প্রেমের বিয়ে আধুনিক। আসলে প্রেম যা মধ্যবিত্তের ভাষায় affair নতুন আচরণ তৈরী করেছে যার অনিবার্য পরিণতি বিয়ে এবং দাম্পত্য জীবন। বিয়ের যুক্তি বা লজিক, বিয়ের ক্ষমতা (শ্রেণী, পুরুষ, পাশ্চাত্য) এগুলো প্রশ্নাতীতই থেকে যায়।
৪. শেষ কথা
এ ধরনের লেখা বেশ বিপজ্জনক। মধ্যবিত্ত মুসলমানের এক স্বামী-স্ত্রী বিয়ে ও পরিবারকে আমরা দেখতে পাচ্ছি পশ্চিমা সাংস্কৃতিক হেজেমনি হিসেবে যার মধ্যে বৈষম্য এবং ক্ষমতা পুনর্নির্মিত। অনেকেরই জিজ্ঞাসা থাকতে পারে : তাহলে পরিবারের মধ্যে, বিয়ের মধ্যে নারী-পুরুষের বৈষম্যহীন কী ধরনের সম্পর্কের কথা আমরা বলছি? আমরা কি চাই যে, যৌন অনুশীলনের ক্ষেত্রে কোন ধরনের নিয়ম শৃংখলাই তাহলে থাকবে না? বিয়ে ব্যবস্থার নৈতিকতা দিয়ে মধ্যবিত্ত আধিপত্য পুষ্ট হচ্ছে এই যদি আমাদের মত হয়, তাহলে নারীমুক্তি প্রশেড়ব বিশ্লেষকদের কাজকে আমরা কিভাবে দেখব? প্রশ্নগুলো অবশ্যম্ভাবী।
কতকগুলো শক্তিশালী দৃষ্টিভঙ্গি ভেঙ্গে পাশ্চাত্য সাংস্কৃতিক হেজেমনিকে উন্মোচন করা,
পাশ্চাত্যের প্রকল্পকে চেনা এবং এই প্রকল্প ও হেজেমনির উৎপাদ হিসেবে বর্তমান বিয়ে ব্যবস্থাকে আবিষ্কার করাই আমাদের মুখ্য লক্ষ্য ছিল। পাশাপাশি, যৌগ বুদ্ধিজীবীদের৪২ এই প্রকল্পে অবস্থান এবং স্থানীয় উপাদানগুলো হেজেমনিতে যে সংমিশ্রিত ভূমিকা রাখছে সেগুলো আমাদের বিবেচনায় ছিল। প্রচলিত আলোচনায় “ঐতিহ্য”, “সনাতন”, “মূল্যবোধ” বলে যা পরিচয় করিয়ে দেয়া হয় Ñ তার পুনরাবিষ্কার জরুরী ছিল। ইহুদী-খৃষ্টীয় একগামী বিয়ের আদলে বাঙ্গালী মুসলমান মধ্যবিত্তের বিয়ে পুনর্গঠিত হয় এবং এই বিয়ে পরিবারের ও সমাজের কেন্দ্রীয় ভিত হয়; মধ্যবিত্ত মতাদর্শের শক্তিশালী মানদণ্ড হিসেবে দাঁড়ায়।
প্রগতিবাদী আলোচনায় এই বিয়ে ও পরিবার গঠনকে পূর্বতন বিয়ে ও পরিবারের সাপেক্ষে নারী-মুক্তির উপায় হিসেবে দেখা হয়। বিশে- ষকদের সরল সমীকরণ হচ্ছে যৌথ পরিবার এবং পুরুষের বহুবিবাহ নারী অধস্তনতার অন্যতম কারণ। এ ব্যাপারে তর্ক করা আমাদের উদ্দেশ্য নয় বরং এই মতামত দিয়ে একক পরিবার ও এক স্বামী-স্ত্রী বিয়েকে কাম্য এবং সমতাকারী হিসেবে দেখা হয়, সেই দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রশড়বাতীতভাবে ছেড়ে দিতে রাজী নই আমরা। পুঁজিবাদী প্রতিষ্ঠান, মতাদর্শ এবং অনুশীলন দ্বারা অর্থনৈতিক ব্যক্তিকরণের (economic individuation) মাধ্যমে পুরুষের ভূমিকা নতুন ভাবে ক্ষমতা লাভ করছে সেই বাস্তবতা বিচার এবং সেই অনুযায়ী ক্ষমতার নুতন ধরন দেখা জরুরী। বৈষম্যের দ্বিতীয় দিকটা শ্রেণীগত। মধ্যবিত্ত মতাদর্শের আধিপত্য বিস্তারেও এই বিয়ে ভূমিকা রাখছে। লেখালেখি, সাহিত্য, গণমাধ্যম, বিজ্ঞাপন মধ্যবিত্ত মানদণ্ডের প্রচারণা চালাচ্ছে। এই বিয়েতে মধ্যবিত্তের ক্ষমতা অদৃশ্য থেকে যাচ্ছে।
পাশ্চাত্যের ক্ষমতার ইতিহাস এবং সেই ক্ষমতা অপাশ্চাত্যের সমাজে অনুবাদের কারণে, পাশ্চাত্য ও অপাশ্চাত্য সমাজের মানুষজন শ্রেণী ও লিঙ্গীয় সম্পর্কের মধ্যে ক্ষমতা ও অধস্তনতার এই ধরন তৈরী করছে। কিন্তু একই ধরন বলা মানে পশ্চিম – অপশ্চিমের ক্ষমতা-সম্পর্ক অদৃশ্য করে ফেলা নয়। অনুবাদ তো পাশ্চাত্যেই হয়, অপাশ্চাত্যে উল্টোটা ঘটে না কখনো। লিঙ্গ, শ্রেণী এবং অনুবাদের ক্ষেত্রে ক্ষমতার এই বিবিধ প্রক্রিয়া এবং তার আন্তঃসম্পর্ককে উন্মোচন করাটা জরুরী হয়ে দাঁড়িয়েছে।
……………………………………………………………………………………………………………………………..
এই লেখার কাজে বুদ্ধি এবং হাস্যরস দিয়ে আমাদের বন্ধু ও সহযোদ্ধা শহিদুল আলম
সমর্থন যুগিয়েছে। ওকে ধন্যবাদ। আরও ধন্যবাদ ’৯৪-’৯৫ শিক্ষাবর্ষের ছাত্রছাত্রীদের,
জ্ঞাতিসম্পর্ক বিষয়ে তাদের আগ্রহী অংশগ্রহণের জন্য।
টীকা ও তথ্যসূত্র
১. দেখুন Leonore Davidoff and and Catherine Hall, Family Fortunes. Men and Women of the English Middle Class, 1780-1850, London, 1987; Christine Delphy, “Sharing the Same Table : Consumption and the Family”, C. C. Harris and M. Anderson (eds) The Sociology of the Family, : New Directions for Britain, University of Keele, Sociological Review Monograph 28, 1979; Hilary Standing, Dependence and Automomy. Women’s Employment and the Family in Calcutta, London, 199; Ges Talal Asad, Some Aspects of Change in the Structure of the Muslim Family in the Punjab Under British Rule (Thesis submitted for the degree of Bachelor of Letters, Exeter College, Trinity Term, 1961).
২. John Beattie, Other Cultures. Aims, Methods and Achievements in Social Anthropology, London, 1964, p. vii.
৩. প্রাগুক্ত, একই পৃষ্ঠায়।
৪. উদাহরণ হিসেবে দেখুন S. F. Nadel, The Foundations of Social Anthropology, London, 1953; E. E. Evans- Pritchard, Social Anthropology, London, 1951
৫. Barbara L. Marshall, Engendering Modernity. Feminism, Social Theory and Social Change, Oxford, 1994; Donna Landry and Gerald MacLean, Materialist Feminisms, Massachusetts, 1993.
৬. দেখুন James Clifford and George E. Marcus, ‘Introduction’, Writing Culture, The Poetics and Politics of Ethnography, Delhi, 1990, p. 23; Henrika Kuklick, The Savage Within, The Social History of British Social Anthropology, 1885-1945, Cambridge, 1991, p. 1.
৭. উদাহরণ পাওয়া যাবে : Lucy Mair, An Introduction to Social Anthropology (second edition), Oxford, 1965(1984), p. 279, 281. AviI †`Lyb A. L. Epstein, Politics in an Urban African Community, 1958.; D. Parkin, Neighbours and Nationals in an African City Ward, 1969.; P. Mayer, Townsmen or Tribesmen, 1961.
৮. Talal Asad, ‘Introduction,’ Genealogies of Religion. Discipline and Reasons of Power in Christianity and Islam, London, 1993, pp. 23-4.
৯. দেখুন Talal Asad, “Are There Histories of Peoples Without Europe?” Comparative Studies in Society and History 29, no 3, 1987.
১০. এদের অনেক লেখালেখি হ’তে দুটো প্রধান কাজ আমরা তুলে ধরছি : E. P. Thompson, The Making of the English Working Class, Penguin, London, 1968. Eric Hobsbawm, Industry and Empire, New York, 1968.
11. Catherine Hall, “Feminism and Feminist History”, White, Male and Middle Class. Explorations in Feminism and History, Oxford, 1992, p. 5.
১২.Davidoff and Hall, 1987, প্রাগুক্ত।
১৩. ১৯৮৭তে প্রকাশিত Family Fortunes সম্পর্কে ক্যাথরিন হল বলছে : “Leonore Davidoff and I used gender conceptually to mean the social organization of relations between the sexes and argued that, though of in this way, gender is a constitutive element in all social relations”. ‘Politics, Post-Structuralism
১৪. ডেভিডফ এবং হল ‘বুর্জোয়া’র স্থানে ‘মধ্যবিত্ত শ্রেণী’ ব্যবহার করছে অধিপতি শ্রেণী বোঝাতে।
14. †WwfWd Ges nj Ôey‡R©vqvÕi ¯’v‡b Ôga¨weË †kªYxÕ e¨envi Ki‡Q AwacwZ †kªYx †evSv‡Z|
15. †hgb : Michele Barrett, Women’s Oppression Today, London, 1980; Juliet Mitchell, Psychoanalysis
and Feminism, London, 1975.
16. D×…Z Ki‡Q Talal Asad, Genealogies, 1963, cÖv¸³, pp.189-190.
17. Asad and Dixon, ‘Translating Europe’s Others,’ in Francis Barker et al (eds), Europe and Its Others,
vol 1, Colehester, 1985, p. 173.
18. Davidoff and Hall, Family Fortunes, pp. 322- 3.
19. mg_©b wgj‡e : Joan Wallach Scott, ‘On Gender, Language and Working Class History’, Gender and The
Politics of History, New York, 1988. Zvi fvlvq, “By ‘language’ I mean not simply words in their
literal usage but the creation of meaning through differentiation. By gender I mean not simply social
roles for women and men but the articulation in specific contexts of social understandings of sexual
difference. If meaning is constructed in terms of difference (by distinguishing explicitly or implicitly
what something is from what it is not), then sexual difference (which is culturally and historically
variable, but which always seems fixed and indisputable because of its reference to natural, physical
bodies) is an important way of specifying or establishing meaning . My argument, then, is that if we
attend to the ways in which ‘language’ constructs meaning we will also be in a position to find
gender.” p. 55.
20. wWm‡Kv‡m©i evsjv Ki‡Z †`wL ÔeqvbÕ| ˆmq` gbRyi“j Bmjvg K‡i‡Qb ˆ`wbK Ômsev`Õ-G 9B Rvbyqvix, 1997| ÔmgvR wbix¶Y
cwÎKvÕ†ZI GKvwaK †jLvq wWm‡Kvm©‡K eqvb ejv n‡q‡Q| Avgv‡`i wePv‡i eqvb n‡”Q Ôb¨v‡iwUfÕ| fvlvi e¨envwiK w`K †f‡eB
fvlvš i nIqv Ri“ix| †m g‡Z, wWm‡Kv‡m©i evsjv‡K PjwZ A‡_©i g‡a¨ †LuvRvI `iKvi|
21. †`Lyb Ann Whitehead, “Some Preliminary Notes on the Subordination of Women”, IDS Bulletin, vol
10, 1979.
22. †Rvb ¯‹U wjL‡Q, Ô… words acquired meaning by implicit or explicit contrasts established in specific
contexts (or discourses). One cannot read Foucault…without understanding that meaning is
multidimensional, established relationally, directed at more than one auditor, framed in an already
existing (discursive) field, establishing new fields at the same time. Positive definitions depend on
negatives, indeed imply their existence in order to rule them out. This kind of interdependence has
ramifications well beyond literal definitions, for it involves other concepts, other relationships in any
particular usage. (Thus, for example, seventeenth century political theorists made analogies between
marriage contracts and social contracts that affected how people understood both; and nineteenth
century socialists depicted capitalist exploitation of workers as prostitution, thereby intertwining
economic and sexual spheres.) Meaning is developed relationally and differentially and so constitutes
relationships’. 1988, cÖv¸³, pp. 59-60.
23. Avgv‡`i 16 b¤^i UxKv †`Lyb|
24. Casey Miller & Kate Swift, The Handbook of Non-Sexist Writing for Writers, Editors snd Speakers,
London, 1981, pp. 81-82.
25. Raymond Williams, Marxism and Literature, Oxford, 1977.
২৬. এখনো শেষ না হওয়া রেহনুমার পি.এইচ.ডি. থিসিস বাঙ্গালী মুসলমান মধ্যবিত্ত শ্রেণী, লিঙ্গ এবং পরিবার গঠনের উপর “ঊংঃধনষরংযরহম
ঋধসরষরবং” : এবহফবৎ, ঈষধংং ধহফ করহংযরঢ় রহ উযধশধ ঈরঃু, সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়। বাঙ্গালী মুসলমানদের মধ্যে শ্রেণী, লিঙ্গ এবং পারিবারিক সম্পর্ক নিয়ে এই লেখাতে যে আলোচনা রয়েছে তা রেহনুমার থিসিসে বি¯ ারিত এবং গভীরভাবে উদ্ঘাটন করা হয়েছে।
২৭. বাম ও উদারনৈতিক বিশে- ষণের সাদশৃ ্য দেখানোর জন্য আমরা রাজা রামমোহন রায়কে বেছে নিচ্ছি। আমাদের সময়ের প্রাগ্রসর সমাজতš ী নারীবাদী লেখক মালেকা বেগম রাজা রামমোহন রায়কে সমালোচনাহীন পর্যালোচনা করছেন। তার ‘নারীমুক্তি আন্দোলন’ (ঢাকা, ১৯৮৫) বইটিতে পাই, “… ইংরেজ ও ইউরোপীয় নারীদের জাগরণের ঢেউ তখন এদেশের ইংরেজী-শিক্ষিত ব্যক্তিদের মনে প্রশড়ব জাগিয়েছিলো, নিজ দেশের নারীদের ভাগ্য বিষয়ে, তুলনা করতে উদ্বুদ্ধ করেছিলো পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের নারীদের অধিকার নিয়ে। রামমোহন রায় প্রম প্রতিবাদ জানালেন নারীর ওপর সামাজিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে। তিনি নারীর হীনাবস্থার বিরুদেধ সে যুগের সমাজে যথেষ্ট
আলোড়ন তুলেছিলেন। সতীদাহ বিষয়ক তাঁর দ্বিতীয় রচনায় (১৮১৯) অত্যš মর্মাšি ক বেদনায় তিনি বলেছিলেন যে, ‘একজন নারী একাধারে রাঁধুনী, শয্যাসঙ্গিনী এবং বিশ্ব¯ গৃহরক্ষী।’ তাঁর ঐকাšি ক একক চেষ্টায় সতীদাহ প্রার বির€দ্ধে জনমত গড়ে ওঠে এবং
ব্যাপক আন্দোলনের ফলে ১৯২৯ সালে সতীদাহ নিষিদ্ধ হলো। পরবর্তীতে ¯ ী-শিক্ষা প্রসারে তিনি যথেষ্ট উদ্যোগ নিয়েছেন। বিলেতে গিয়ে (১৮৩০) নারী-জাগরণের স্বরূপ স্বচক্ষে দেখে তিনি অভিভ‚ত হয়েছিলেন, আকা খা প্রকাশ করেছিলেন বাংলার নারীদের তেমনিভাবে জেগে ওঠা যদি সম্ভব হতো।” (পৃ. ৮৪) মালেকা বেগমের লেখায় রামমোহনের গুরুত্ব যেভাবে ধরা পড়ছে তা কিন্তু খুব ভিনড়ব নয়, উদার অবস্থান হতে গোলাম মুর্শিদ যা করছেন তার সাথে। গোলাম মুর্শিদ লিখছেন,
“During the period under review (1849- 1905), Bengali women occupied a very inferior social position. In his second pamphlet on suttee, published in 1819, Rammohan Roy observed that a woman was considered to be no more than a useful creature who could be at once a cook, a sexual partner and a faithful housekeeper… Men (Bengali) did not recognize the need to educate women. Worse still, men held an extremely poor opinion of women maintaining that women were devoid of all intellectual abilities and could never be educated. If popular male opinion in England, at that time was not so severe, some men still held that women were intellectually inferior to men…However, as English education and Western ideas permeated a segment of urbanized middle-class men, that segment, though small, came to question the existing status of Bengali women. These men compared the position of their women with that of European women and found a great difference in that the latter were not secluded in their homes nor were they kept completely illiterate. On the contrary, they found that English women were given some education and were encouraged to acquire such accomplishments as singing and dancing… Rammohan Roy was the earliest to expose the deplorable condition of the womenfolk of Bengal. No one knows exactly how he became conscious of the very low position of women…Whatever, his sources of inspiration, he severely attacked the male-dominated Hindu society, saying that it was selfish and hypocritical and that it denied to them (women) those excellent merits that they are entitled to by nature. When he went to England he was most impressed by the female virtue and excellence in this country”. †`Lyb Reluctant Debutante, Rajshahi, 1983, pp. 21-4.
২৮. বাঙ্গালী হিন্দু মধ্যবিত্তের মতই বাঙ্গালী মুসলমান মধ্যবিত্ত সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির চাহিদা অনুযায়ী গড়ে উঠেছে। শিল্প বুর্জোয়া বিকাশ হ’তে নয় বরং সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির প্রয়োজনীয় চাকরিজীবী, আমলা হ’তে গড়ে উঠেছে তারা (দেখুন ঐরষধৎু ঝঃধহফরহম, ১৯৯১, প্রাগুক্ত ঢ়. ২৫)। উনিশ শতকের শেষভাগে ঔপনিবেশিক শাসনের ‘ডিভাইড এণ্ড রুল’ নীতি বাঙ্গালী মুসলমান মধ্যবিত্ত শ্রেণীর গঠনকে ত্বরান্বিত করেছে। এরা এসেছে পূর্ববাংলার বহুবিধ কৃষিজ সামাজিক দল হ’তে, যেমন : ক্ষুদ্র ভ‚মিমালিক, ধনী ও মধ্য কৃষক, বেপারী ইত্যাদি। ‘শিক্ষিত সমাজ’ হিসেবে এদের আÍ-পরিচয় তৈরী হ’ল; রাজনৈতিক, মতাদর্শিক এবং নৈতিক নেতৃত্ব দিতে পারল তারা Ñ সেই বা¯ বতাকে বোঝা
সম্ভব ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর মধ্যেই, যার মধ্যে এরা বেড়ে উঠেছে। মধ্যবিত্ত মুল্যবোধের আকর হয়ে দাঁড়াল ‘শিক্ষা’ ও ‘চাকরি‘। ‘শিক্ষা’ মানে শুধুই প্রাগত শিক্ষা নয়, বরং পশ্চিমা আলোকময়তা এবং প্রগতিবাদিতা। এর জোরেই তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল পাতি ব্যবসায়ী বা অন্য কাউকে সুযোগ মত শ্রেণী বহির্ভত‚ হিসেবে চিহ্নিত করা (যেমন : ‘অশিক্ষিত ব্যবসায়ী’)। এজাজ আহমেদের চিš া বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে অনুধাবন করবার ক্ষেত্রে সহায়তা যুগিয়েছে। তার যুক্তিগুলো হচ্ছে : প্রমত, প্রাšি ক সমাজে বুর্জোয়া ও প্রলেতারিয়েতের মধ্যে ব্যাপক মেরুকরণের অনুপস্থিতি হেজেমনিক নিয়š ণের জন্য অনেকটা জায়গা তৈরী করে; দ্বিতীয়ত, প্রাšি ক সমাজগুলোতে অর্থনৈতিক
ক্ষেত্রসহ সব ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রের μমবর্ধমান ভ‚মিকা হেজেমনিতে মধ্যবিত্তের প্রচেষ্টাকে মদদ যুগিয়েছে রাষ্ট্রযšে মধ্যবিত্তের শক্তিশালী উপস্থিতির কারণে; তৃতীয়ত, মধ্যবিত্তের ‘নীতিমালা’ এবং ‘আদর্শমালা’ শুধু যে প্রলেতারিয়েত এবং কৃষক শ্রেণীর ওপর আধিপত্য বি¯ ারে কাজ করে তাই নয়, বরং ধনবান শ্রেণীর ওপরও তা μিয়াশীল। দেখুন
২৯. যেমন দেখুন বদরুদ্দীন উমর, বাংলাদেশে আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনের ধারা, ঢাকা, ১৯৮৭; B. K. Jahangir, Problematics of
30. Talal Asad, “A Comment on Translation. Critique and Subversion”, in Anuradha Dingwaney and Carol Maier (eds), Between Languages & Cultures. Translations & Cross-Cultural Texts, Delhi, 1996.
৩১. Asad and Dixon, 1985, প্রাগুক্ত, p. 171
৩২. সৈয়দা মনোয়ারা খাতুন, স্মৃতির পাতা, আনিসুজ্জামান স¤žাদিত, ঢাকা, ১৯৯২, পৃ. ১৬-১৮।
৩৩. আখতার ইমাম, “আমাদের সেকাল,” নুর€নড়বাহার স¤žাদিত কালের সম্মুখ ভেলা, ঢাকা, ১৯৮৮, পৃ. ২৭।
৩৪. দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, অতীত জীবনের স্মৃতি, ঢাকা, ১৯৮৭, পৃ. ৭২-৭৩।
৩৫. কামরুদ্দীন আহমেদ, বাংলার মধ্যবিত্তের আÍবিকাশ, প্রম খণ্ড, ঢাকা, বাংলা সন ১৩৮২, পৃ. ২৪, ৯২।
৩৬. দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, ১৯৮৭, প্রাগুক্ত, পৃ. ৭২।
৩৭. এ ধরনের তথ্যের স্বপক্ষে কামরুদ্দীন আহমেদ তাঁর পারিবারিক জীবন হ’তে বর্ণনা দেন : “আমার দাদী-আম্মার এক ভাই ছিলেন, নাম ছিল
তাঁর ওসমান আলী ভঁই‚ য়া। তিনি ছিলেন ঢাকা জেলার প্র ম মুসলমান আদালতি উকিল। তিনি পি. এল. পাশ করে “পি- ডার” বা উকিল হয়েছিলেন। তাঁর আরজি, জবাব, মুসাবিদার পারদর্শিতার কথা আমি বহুকাল পরে ওকালতি করার সময় বৃদ্ধ উকিলদের কাছে শুনেছি। তাঁর টাকার অভাব ছিল না Ñ বিবাহ করেছিলেন একাধিক, তবু টাকার সঙ্গে যেসব উপসর্গ জুটত তা থেকে তিনি পরিত্রাণ পাননি। মদিরা পান ও বাঈজীর নাচ-গান দুটোর প্রতিই ছিল তাঁর সমান আকর্ষণ। দাদী-আম্মার কাছে শুনেছি যে, তিনি যখনই আমাদের বাড়ী আসতেন তখন বড় বজরা নৌকা ভাড়া করে আসতেন আর রাত কাটাতেন সে বজরায় কারণ সেখানে তাঁর সখের ও আনন্দোৎসবের সব রকম ব্যবস্থাই থাকত।”
দেখুন কামরুদ্দীন আহমেদ, বাংলা সন ১৩৮২, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৩-২৪।
৩৮. Hilary Standing, 1991,প্রাগুক্ত, pp. 90-92.
৩৯. দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, ১৯৮৭, প্রাগুক্ত, পৃ. ৭৩।
৪০. পুঁজিবাদী রূপাš রের সময়ে মধ্যবিত্ত শ্রেণী চৈতন্যের এই গঠন কোন আকস্মিক ব্যাপার নয়। যৌগ (ড়ৎমধহরপ) এবং অগ্রণী
(vanguard) বুদ্ধিজীবীরা বাঙ্গালী মুসলমানদের মধ্যেও সμিয় ভ‚মিকা পালন করেছেন। তাঁদের লেখালেখি, প্রচারণা, পু¯ি কাতে মতাদর্শ
নির্মাণ ও সংবহনের কাজের বি¯ র নজির পাওয়া যায় Ñ যেগুলো আমরা উদ্ধৃত করছি না।
৪১. মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বাইরে গ্রামীণ/কৃষি সমাজে, লোক সমাজে “সংসার” কথাটি ভিনড়ব অর্থ বহন করে। “বিশ্ব” বা “জগৎ” অর্থে শব্দটি ব্যবহার
করা হয়।
৪২.Organic intellectual-এর বাংলা “অঙ্গীয়” বা “জৈব” বুদ্ধিজীবী করা সুবিধেজনক মনে হয়নি আমাদের কাছে। গ্রামসীর বিশে- ষণে মৌলিক যে বৈশিষ্ট্য ধরা পড়ে এই বুদ্ধিজীবীদের চরিত্র চিত্রণে তা হ’ল একটি বিকাশমান সামাজিক শ্রেণীর উৎপাদ হিসেবে “একজোট” হয়ে তাদের ভ‚মিকা। সেই ভ‚মিকা হচ্ছে সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সেই শ্রেণীর কিছু সমরূপ আÍ-চৈতন্য দাঁড় করিয়ে দেয়া।
(দেখুন Terry Eagleton, Ideology. An Introduction, London, 1991, pp. 118-119)|। “যৌগ” সে অর্থেই ব্যবহৃত। [লেখাটি প্রকাশিত হয় সমাজ নিরীক্ষণ-এর ৬৩ সংখ্যায়, সমাজ নিরীক্ষণ কেন্দ্র, ঢাকা, ফেব্র“য়ারী ১৯৯৭]
Be the first to write a comment.