
৫ এপ্রিল। অন্তু রায়ের ছবিটা ফেসবুকে বারবার সামনে আসছিল। মায়াভরা একটা মুখ। দেখলেই কেমন আপন লাগে, যেন নিজের সন্তানের মত। তখনো নিউজ হেডলাইনটা নজরে দেইনি। মিষ্টি মুখটা দেখে খবরটা পড়তে গেলাম, ভীষণ দুমড়ে-মুচড়ে গেল বুকের ভেতরটা। অভাবের কারণে আত্মহত্যা করেছে কুয়েটের ছাত্র অন্তু! হলে ডাইনিং এ খাবারের টাকা বকেয়া পড়েছিল। সেই টাকা শোধ করার ক্ষমতা ছিলনা তার বাবা-মায়ের। তার পরদিনই, রিকশাচালক নাজমুলের আত্মহত্যার খবর। জরিমানার টাকা দিতে পারিনি নাজমুল।… তারও আগে সেচের পানির যোগান করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছেন কৃষক অভিনাথ আর রবি মারান্ডি।না কোনো প্রতিক্রিয়া জানাইনি। পরের দিনই জীবন-জীবিকার প্রবাহে ভেসে গেছি। আহাউহু করেছি, কিন্তু পরক্ষণেই ভুলে গেছি। এই নগরে প্রতিদিন অবিরত হাজার সমস্যার সাথে স্ট্রাগল করতে করতে কী এক অভিনব ধৈর্যশক্তি ডেপেলপ করেছে আমাদের মাঝে! কোন ক্ষরণই আমাদের গতি আর থামায় না। বোধহীন, প্রাণীর মতো শুধু সারভাইভেল এর জন্য ছুটে চলি।কিন্তু কেউ কেউ এই প্রাণিসত্তার ভেতরের মানুষটাকে কষে চপেটাঘাত করে। ছাত্র ফেডারেসশন নেতা আলামিন শেখ গিয়েছে অন্তুদের বাড়ি, সেই বাড়িতে অন্তুর শ্রাদ্ধানুষ্ঠান-মায়ের আহাজারি-পরিবারের শোকের মাতমের হৃদয়বিদারক অভিজ্ঞতার লিখেছেন আলামিন। আবারও থমকে দাঁড়ালাম ক্ষণিক।
এইযে আত্মহত্যা…একি শুধু ব্যক্তির ব্যর্থতা!!! মুক্ত-বাজার অর্থনীতির পরিপোষক রাজনৈতিক সমাজপতিরা নিশ্চয়ই তাই বলবেন। এই ধারার দর্শনের সমর্থক সমাজবিজ্ঞানী Herbert Spencer যেটিকে বলেছেন Survival of the Fittest! অতএব, অন্তুরা এসমাজের জন্য ফিট না। কিন্তু আমরা আনফিটদের সংখ্যা দিনে দিনে বাড়ছি। আবু নাসের অনিকের Abu Naser Anik ফেসবুক পোস্টে দেখলাম এদেশে এক বছরে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে চৌদ্দ হাজারের বেশি!!!! তাহলে এতসংখ্যক আত্মহত্যার দায় কি শুধু ব্যাক্তির ব্যর্থতা হিসেবেই দেখবো আমরা!!! সমাজবিজ্ঞানী Durkheim দেখিয়েছেন, সমাজের মধ্যে নৈরাজ্য (Anomie) বাড়লে অর্থাৎ সমাজের নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান (রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ) যখন সমাজকে যথাযথভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে বড় আকারে ব্যার্থ হয়, তখন সমাজের মধ্যে আত্মহত্যার ঘটনা বাড়তে থাকে। আমাদের বর্তমান সময়কে Durkheim থিউরি অনুযায়ী Anomie এর চূড়ান্ত উদাহরণ হিসেবে ধরা যায়। এখনকার বিদ্যমান সরকার (সমাজের নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ) বিনা ভোটে নির্বাচিত। ফলে প্রথমত তারা সমাজ-অর্থনীতিকে যথাযথভাবে ম্যানেজ করার দায় সহজে এড়িয়ে যেতে পারছেন।
আমরা দেখছি, পুঁজিপতি-ব্যাবসায়ীরা (যারা আবার নানাভাবে সরকারী ক্ষমতার অংশ) লাগামহীন মুনাফা করছেন। ব্যাবসায়ীরা সিন্ডেকেট করে জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে চলছে। উন্নয়নের প্রজেক্টের কোটি কোটি টাকা মেরে খাচ্ছে ঠিকাদারি-ব্যাবসায়ী-সরকারি কর্মকর্তা-রাজনৈতি এমপি-মন্ত্রী সিন্ডিকেট । কোথাও কোনো নিয়ন্ত্রণ নাই-যে যেভাবে পারো লুটে নাও। তাদের পাহাড়সম মুনাফার তোড়ে দেশের মাথাপিচছু আয় দাঁড়িয়েছে ২৫০০ ডলার (প্রায় ২০০০০০ টাকা)। কিন্তু এই গল্পের শুভঙ্করের ফাঁকি সবার জানা—আর তাই ২০০০০০ টাকা মাথাপিছু আয় থাকা সত্ত্বেও অন্তুকে মাত্র ৬ হাজার টাকার জন্য গলায় দড়ি দিতে হয়েছে। আর মাননীয়রা বলছেন, তেল ছাড়া রান্না করতে…কুমড়া দিয়ে বেগুনি বানাতে…। কে যেন একজন স্যাটায়ার করে বলেছিল, এবার প্রস্তাব আসবে চাল ছাড়া ভাত রান্না করার।আমরা এক ভয়াবহ আশংকাজনক পরিস্থিতির দিকে এগুচ্ছি! আমরাও কি অন্তুর মতো সামাজিক নিয়তির কাছে হার মানবো!!!
লিখা: শ্যামলি শীল – শিক্ষক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। ছবি: অনলাইন
Be the first to write a comment.