কাশ্মীরে গুম হয়ে যাওয়া মানুষদের স্ত্রী আর মায়েদের প্রাত্যহিক জীবনের লড়াই নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ করেছিলেন এন্থ্রোপোলজিস্ট Ather Zia। ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া- আরভাইনে তার পিএইচডি থিসিস ছিল সেটা। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর হিসাব মতো, ১৯৯০তে কাশ্মীরে ক্র্যাকডাউন শুরু হলে প্রায় ৭০,০০০ মানুষ মারা যায়, গুম হয় প্রায় ৮হাজার। উপমহাদেশের মুসলিম আইনে কোন নারী বিধবা হয়ে গেলে আবার বিয়ে করতে পারে। কিন্তু কারও স্বামী গুম হয়ে গেলে ৭বছরের মধ্যে আবার বিয়ে করতে পারেনা। কাশ্মীরের গুমের ঘটনা এত ভয়াবহ পর্যায়ে চলে যায় যে, সেখানে উলামারা শেষমেশ ফতোয়া জারি করে যে, কারও স্বামী গুম হলে ৪বছর পর সে বিয়ে করতে পারবে। কিন্তু বাস্তবে জিয়া দেখান, প্রায় ৯১শতাংশ মেয়েরাই আর বিয়েতে আগ্রহী-ই হয়ে উঠেনা। এসব মেয়েরা জানেই-না তার স্বামী আদৌ বেঁচে আছেন, নাকি মারা গেছেন। এটার নাম দিয়েছিলেন তিনি “হাফ-উইডো”।
এরকম-ই এক ‘হাফ-উইডো’ সাদাফের প্রাত্যহিক দিনলিপি জিয়া খুব সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। কাশ্মিরি এবং মোটাদাগে মুসলমান সমাজের একটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এখানে মেয়েরা হারিয়ে যাওয়া মানুষদের জন্য ঘরে বসে আড়ালে শোক-বিলাপ করে, কান্না করে। কিন্তু সাদাফদের মত হাফ-উইডো যারা, তারা ঠিক ঘরে বসেই শোক পালন করেনা। প্রতিমাসে রাজধানীতে তারা পাবলিকলি একত্র হয়, নিখোঁজ স্বামী-সন্তান-বাবার ছবি নিয়ে হাজির হয়, তাদের স্মরণ করে। গুম হয়ে যাওয়া এসব মানুষদের পরিবারের সদস্যরা Association of Parents of the Disappeared Persons বা এপিডিপি নামে একটা সংগঠনও করেছে। এই সংগঠনের মধ্য দিয়ে সাদাফের মত মেয়েরা প্রতিনিয়ত তাদের লড়াই জারি রেখেছে। আমাদের মত সমাজে অনেকেই মনে করে প্রেসারগ্রুপ সংগঠন করা, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াই করা এগুলো পুরুষদের কাজ। কিন্তু এখানে দেখুন, এই লড়াইগুলো মেয়েরা করছে। যেখানে মনে করা হয় পুরুষরা মেয়েদের হেফাজত করবে, সেখানে পুরুষদের খোঁজে মেয়েরা চারিদিক হন্য হয়ে ছুটছে। ফলে তারা যেভাবে লড়াই করছে, গুম হয়ে যাওয়াদের খুঁজছে, পাবলিকলি শোক জ্ঞাপন করছে, এইটাকে স্রেফ পিতৃতন্ত্র দিয়ে বোঝা মুশকিল। স্মরণসভা থেকে ফিরেও তাদের দৈনন্দিন লড়াইগুলো থেমে থাকেনা।
সাদাফ মারাত্মক নস্টালজিয়াতে ভুগে। ঘরে যখন সে এক কাপ চা বানায়, মাঝে মাঝে আরেকটা কাপ বানায়ে রাখে স্বামী মানজুর খাবে বলে। স্বামীর জামা-কাপড় খুব সুন্দর করে পরিপাটি করে রাখে, তার বিশ্বাস সে একদিন ফিরে আসবে। ঘরে আসা মাত্রই সাদাফ প্রায়-ই উজ্জ্বল বা লাল কালারের জামা পরে। যখন মনজুর ছিল, সাদাফ তখন ঘরে-বাইরে সবসময় নিজেকে সুন্দর রাখার চেষ্টা করত, প্রায় সেজেগুজে থাকত, যেটা তার স্বামীর খুব পছন্দও ছিল। কিন্তু সে এখন যখন ঘরের বাইরে যায়, আর উজ্জ্বল জামাটা পড়েনা। একটা চাদর গায়ে দিয়ে যায়। তার স্বামী গুম হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে তার জীবনের শখ আহ্লাদগুলো সব হারিয়ে যায়। সারাক্ষণ স্বামীর দুশ্চিন্তায় থাকতে থাকতে সাদাফের চোখের নিচে কালো দাগ পড়ে গেছে, রাতে ঘুম হয় না। মাসিকের ব্লিডিং শুরু হলে বন্ধ-ই হয় না। স্বামীর গুম হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে এভাবেই সাদাফের শারীরিক-মানসিক অবস্থারও দারুণ অবনতি ঘটেছে, কিন্তু তাই বলে তার লড়াইটা থেমে থাকেনি কোনদিন। স্বামীর প্রতি দারুণ বিশ্বস্ত সে। প্রতি মাসে এপিডিপির প্রোগ্রামে যাচ্ছে, যখন-ই শুনছে কোথাও একটা লাশ পাওয়া গেছে বা একটা বন্দীকে দেখা গেছে, সেখানেই দৌড়ে যাচ্ছে।ক্যাম্প থেকে ক্যাম্পে, জেল থেকে জেলে, থানা থেকে থানায়।
ভারত রাষ্ট্রে কেউ গুম হলে সহজেই পুলিশ কোন জিডি বা এফআইআর নিতে চায় না, ফলে কতজন গুম হয়েছে রাষ্ট্রের তরফ থেকে তার সঠিক কোন ডকুমেন্টেশন নেই। এভাবে থানা বা আদালতে অভিযোগ গ্রহণ না করার মাধ্যমে রাষ্ট্র গুম হয়ে যাওয়া মানুষদের সংখ্যাকেও গুম করে দেয়ার পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে। সাদাফ এরপরও থানায় যায়। তাকে নানানজন খোটা দেয়, কেন এসব করছে, এসব করে কি লাভ, আবার বিয়ে করেনা কেন। জিয়া দেখাচ্ছেন, হাফ উইডোদের অনেককে পরিবার থেকে আবার জোর করে বিয়ে দেয়া হয়, কেউ বা আবার করুণা করে হাফ-উইডো কাউকে বিয়ে করে, কিন্তু কয়েক মাস –বছর পর বুঝা যায়, এসব আসলে এক্সিডেন্টাল ম্যারিজ। অনেক হাফ-উইডো আবার এভাবেই প্রতারণার শিকার হয়। একসময় পাড়ার সবাই সাদাফকে বলিউড স্টার বলত, এখন তার চেহারার দিকে তাকিয়ে সবাই বলে, সে বয়সের ছেড়ে বুড়ো হয়ে গেছে। খোঁটা নিত্য সংগী আবার। সাদাফ একসময় এনেস্থেশিয়ান ছিল, স্বামী গুম হয়ে যাওয়ার পর চাকুরি ছেড়ে এখন একটা বিউটি পার্লার করেছে যাতে বাইরে কোন পুরুষ মানুষের সাথে সাক্ষাৎ করা না লাগে। ছোট ছোট বাচ্চাদের নিয়ে পুরো সংসার সামলাচ্ছে। সমাজের যাবতীয় আচার-আচরণ সে মানছে, স্বামীর প্রতি এখনও দারুণ বিশ্বস্ত, আবার লড়াইও জারি রেখেছে। মেয়েদের এই এজেন্সি ইউনিক। সাদাফদের এই লড়াই আতহার জিয়া যেভাবে তুলে ধরেছে, বইটা পড়ে কয়েকদিন খুব অস্বস্তি কাজ করেছিল।
আন্তর্জাতিক গুম সপ্তাহ উপলক্ষে আজ (গত ৩০ আগস্টে) জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে আয়োজিত ‘মায়ের ডাক’ অনুষ্ঠানে হাজির এরকম গুম হয়ে যাওয়া মানুষদের আত্মীয়দের ছবি দেখে আতহার জিয়ার লেখাটা মনে পড়ল। বাংলাদেশের এসব মায়েরা, এসব হাফ-উইডোরা, বাবা হারা সন্তানরা তাদের লড়াইও কি সাদাফের লড়াই থেকে ভিন্ন কিছু? বাংলা ট্রিবিউনে দেখলাম একজন প্রশ্ন করছে, “বাবা কি বেঁচে আছেন, না থাকলে কবর কোথায়”। আমাদের কাছে কোন উত্তর আছে?
লেখাঃ খন্দকার রাকিবের ফেসবুক টাইমলাইন থেকে
Be the first to write a comment.